Skip to main content

মনোময় মিত্তিরের টার্গেট

বালি, রাতের শীতলতায় নরম বালি। ঢেউ ঝাপটে পড়ছে; একটানা। যেমনটা নিয়ম। মাঝে মাঝেই কয়েকটা ঢেউয়ের বাড়তি দাপট ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বিমলবাবুর পাজামার নিচের দিকটা। পায়ের পাতা ভিজে যাওয়াটা মন্দ লাগছিল না। দু'হাত ভাঁজ হয়ে মাথার নিচের বালিশ হয়েছে। আকাশ কালোয় কালোয় বুকে চেপে বসছিল ক্রমশ, কানে আছড়ে পড়ছিল বঙ্গোপসাগর।

পুরী শহরটা এ প্রান্তে এসে  স্তিমিত হয়ে পড়ে। এখানে বিমলবাবুর চিত হয়ে শুয়ে থাকাটা দৃষ্টিকটু নয় মোটেও। অল্প ঘোর লাগে চোখে, বুকে। 
একটা তারার চিকমিকের অসোয়াস্তিতে চোখ বন্ধ করেন বিমলবাবু। 
খানিকক্ষণ আগে যে খিদে-ভাবটা মাথাচাড়া দিচ্ছিল সে'টাকে দাবিয়ে দেওয়া গেছে। মানি ব্যাগে সাতাশটাকা রয়েছে, দিব্যি রুটি সবজী হয়ে যেতে পারে। তবে হলেই তো হতে দেওয়া যায় না। অবিশ্যি এমার্জেন্সির জন্য ঝোলানো সাইডব্যাগে দু'টো বিস্কুটের প্যাকেট আর আধ বোতল জল রয়েছে। 

পকেট হাতড়ে বিড়ি বের করে আনেন বিমলবাবু। সমুদ্রের হাওয়ার ঝাপটা বাঁচিয়ে বিড়িটা ধরল চার নম্বর দেশলাইরে কাঠিতে। বিড়ি জাতে কড়া কিন্তু চুরুট মাফিক শুধু ফুসফুস পলিউট না করে বুকের আনাচেকানাচে কিছুক্ষণ অন্তত ঘোরাফেরা করে। 

পাজামাটা হাঁটু অবধি যখন ভিজল, তখন বিমলবাবু ঠাহর করতে পারলেন যে রাত বাড়ছে। কালো আকাশটা তখন নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। 

বিড়িতেও খিদে কমে। বিমলবাবু জানেন। 

**

ঝিমটি যখন ভাঙল তখন হাতঘড়িতে সময় রাত পৌনে তিনটে। পিঠ ভিজে গেছে। একরকম হুড়মুড় করে উঠে পড়তে হলো বিমলবাবুকে। পাঞ্জাবির পকেটে রাখা বিড়ির প্যাকেট বড্ড ভিজেছে, মিনিমাম ছ'টা বিড়ি জাস্ট জলে গেলো।  

**
- আসুন। 
- কী ব্যাপার? আমায় এমন ভাবে ধরে আনার মানেটা কী?
- অত রাত্রে বীচে কী করছিলেন?
- শুয়েছিলাম। 
- সে'তো হাবিলদার দেখেইছে। গাঁজা?
- গাঁজা?
- কী টানা হয়? 
- কী টানব?
- ন্যাকামি হচ্ছে?
- কীসের ন্যাকামি? আমি গাঁজা-টাজা টানি না।
- হেরোইন চরস? থাবড়ে কথা বের করে নেবো। 
- আরে কী মুশকিল। 
- মুশকিলের আর দেখলেনটা কী? স্ট্রেট চালান করে দিচ্ছি। তারপর বুঝুন ঠ্যালা। 

**

মনোময় মিত্তির যখন পুরী এক্সপ্রেসের এস-ছয়ের  লোয়ার বার্থটায় বসলেন, তখন তার মুখে স্বস্তির হাসি।

- তাহলে চলি দারোগাবাবু!
- দারোগা বলে আর লজ্জা দেওয়া কেন। গতকালই আমার রেসিগনেশন এক্সেপ্টেড হয়ে গেছে। বিমলবাবু বললেই ল্যাঠা চুকে যায়। 
- বেশ, এবারে তাহলে টাইম টু সে গুডবাই বিমলবাবু। আপনার আতিথেয়তা  ভুলবার নয়। 
- সরি, আপনাকে প্রথম দিন জেলের লপসি খেতে হয়েছিল। 
- আরে সে'সব কবে ভুলে মেরে দিয়েছি।
- তবে মনোময়বাবু, যা দিয়ে গেলেন, তা যে সত্যিই ভুলবার নয়। আমি কী বলে যে আপনাকে...। 
- আমায় সে'বার দিয়েছিলেন জলপাইগুড়ির সমাদ্দার। তিনি পেয়েছিলেন বেনেটোলার দত্ত বলে কারুর থেকে। এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
- আহ, সব পাওয়ার চেয়ে বড় পাওয়া। 
- বটেই তো। আপনাকে এনভি করতে হচ্ছে। 
- আর এনভি করে লাভ নেই! ডিল ইজ আ ডিল। ভদ্দরলোকের এক কথা!  আমার সমস্ত সম্পত্তি একবার এক্সেপ্ট করে নিয়েছেন, আর রিফিউজ করতে পারবেন না। তবে ইয়ে...মিস্টার মিত্তির...আপনার দেওয়াটুকু যে কোনওদিন ভুলবার নয়। রাতের সমুদ্দুর আর নির্ভার পকেট, যে পেয়েছে সেই জানে। 
- আহ! বেশ বেশ! ডিল তো ডিল। তবে মনে রাখবেন। এ আনন্দধারা অরণ্যদেবের বংশের মত। বেনেটোলার দত্ত যেমন দিয়েছিলেন জলপাইগুড়ির সমাদ্দারকে, তার বদলে ধারণ করেছিলেন তাঁর সম্পত্তির বিষ।  বছর দশেক সে মহানন্দ ভোগ করার পর জলপাইগুড়ির সামাদ্দার সে আনন্দ ভাণ্ডার আমায় সঁপে যান, বদলে ধারণ করে নেন আমার যাবতীয় সম্পত্তির বিষ। আমি নিরন্তর এ আনন্দ ভোগ করলাম বছর দশেক। এবার নতুন অরণ্যদেব, থুড়ি, সমুদ্রদেবের পালা; আপনাকে এ অপার আনন্দ ভোগের অধিকার দিয়ে গেলাম। যন্ত্রণা বলতে; আপনার সম্পত্তির গরল নিজের কণ্ঠে ধারণ করে যেতে হচ্ছে, তবে পিছপা হলে তো চলে না। দশ বছর পর আপনাকেও এ আনন্দ অন্য কাউকে সঁপে যেতে হবে। 
- হবেই?
- হবেই। 
- বেশ। সে না হয় দশ বছর পর দেখা যাবে। তদ্দিন তো এ রাত্রে সমুদ্র আমার। আমারই। 
- বিলকুল। যাক দারোগাবাবু...ইয়ে...থুড়ি...বিমলবাবু...আর ট্রেন ঘেঁষে দাঁড়াবেন না। সিগনাল দিয়ে দিয়েছে বোধ হয়। আপনি এবার আসুন। 
- আসি আমি মিত্তিরবাবু। কেমন? এখান থেকে তো সোজা সেই সমুদ্রের ধারে গিয়ে থেবড়ে শুয়ে পড়া, টিল সানরাইজ। অতঃপর মাধুকরী। 
- কেমন? মনে স্ফূর্তির ফ্লো'টা টের পাচ্ছেন তো বিমলবাবু?
- বিলক্ষণ। বিলক্ষণ! 

**

ট্রেন হাওড়ায় ঢুকল আধ ঘণ্টা দেরী করে। অবশ্য সবিশেষ তাড়াহুড়োয় ছিলেন না দুনিয়ার একমাত্র রাত-আকাশ-সমুদ্রের সেল্‌সম্যান মনোময় মিত্তির। এ ব্যবসাকে স্ক্যান্ডালাস্‌ বলে ছোট করতে মনে সরে না তাঁর। 
এ'টা সেল্‌স; যেখানে টার্গেট বলতে দশ বছরে একটা মক্কেল।  

বিমল দারোগার কল্যাণে, দিব্যি আগামী বছর খানেক বিড়ির বদলে চুরুট-মেজাজি করে কাটানো যাবে'খন। 

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু