Monday, December 8, 2014

ইতিহাস

সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়া মন্দ্ররাচের মুখে ঝাঁপটা মেরে যাচ্ছিল বারবার। হাওয়ায় হালকা শীতের মিশেল। আলোয়ানটা ভালো করে গায়ের সঙ্গে লেপটে নিলেন তিনি। ঢেউয়ের দাপট দেখে ঠাহর করলেন যে জোয়ার এসেছে। সূর্য উঠতে আর ঘণ্টাখানেকের বেশি দেরি নেই তবে। তবে এখনও চারপাশে চাপ চাপ অন্ধকার। ঢেউয়ের ফেনার সফেদ ছাড়া আর নজরে কিছুই পড়ে না। দুশ্চিন্তা সামান্য ছিলই মন্দ্ররাচের মনে। সকলের এতক্ষণে চলে আসার কথা ছিল। কিন্তু কেউই আসেনি। তবে কি পরিকল্পনা মুলতুবি হল?মেঘ-কালো নিকষ আকাশের দিকে চেয়ে আকাশ-কুসুম ভাবনায় ঋজু হয়ে আসছিলেন মন্দ্ররাচ।

“মন্দ্র,কতক্ষণ হল এসেছো? দুঃখিত, আমার দেরী হল। আসলে রাস্তার যা অবস্থা তা তো জানোই” হম্মদ্ম’র ডাকে সম্বিত ফিরে পেলেন মন্দ্ররাচ, আলিঙ্গন করলেন তাকে। দু’জনে মিলে ঢেউ বাঁচিয়ে বালির ওপর বসলেন।

“কী যে বলবো, ঠাহর করতে পারছি না হে হম্মদ্ম। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে হয়তো ভুল করছি। যার যন্ত্র ঘিরে এতসব পরিকল্পনা, সেই উটননি ব্যাটারই সন্দেহ দূর হচ্ছে না”, ঢেউয়ের দাপুটে শব্দ ছাপিয়ে মন্দ্রারাচের দীর্ঘশ্বাস হম্মদ্মের কানে এলো।

“উটননির বয়স অল্প, তিরিশও নয় বোধ হয়, আমাদের মত চল্লিশে ভোঁতা হওয়া তেতো বয়স নয় ওর”, নম্র বিষণ্ণতা কে আড়াল করার চেষ্টায় হাসলেন হম্মদ্ম, “তার মাথায় বিস্তর চিন্তা আসবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। তা ছাড়া, সে পরম জ্ঞানীও বটে। তবে অর্জিত জ্ঞানের পরিধি মানুষকে অজ্ঞানতার মতই কখনও কখনও তীব্র ভাবে বেঁধে ফেলতে পারে মন্দ্র”।


“তুমি খুব সহজে সুন্দর কথা বলতে পারো হম্মদ্ম”,আন্তরিক সুরে বললেন মন্দ্ররাচ।
“অনেককিছু যে তোমার থেকে শিখেই আয়ত্ত করে নেওয়া ভাই”, হম্মদ্ম হাসলেন।

খানিক পড়েই কয়েকজনের কণ্ঠস্বরের শব্দ পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন মন্দ্ররাচ ও  হম্মদ্ম। চারটে ছায়ামূর্তি তাদের দিকে হেঁটে আসছে।
“আর তো কেবল মাত্র সাজিস আর উটননির আসার কথা। তবে চারজন হেঁটে আসছে কেন?”, সন্দিগ্ধ হয়ে উঠলেন হম্মদ্ম।
“অস্ত্র সঙ্গে আছে”, আশ্বাসের সুরে বলে উঠলেন মন্দ্ররাচ।

কিন্তু ছায়ামূর্তিগুলো কাছে আসতেই দু’জনের মুখ থেকে দুশ্চিন্তা মিলিয়ে গেল। উটননি আর সাজিসই আসছে, সঙ্গে স্বয়ং উপাচার্য রন্দ্র এসেছেন। উটননির পাশে একটি উটননির চেয়েও অল্প বয়সের এক যুবক, যার কাঁধে একটি বিবর্ণ থলে। হম্মদ্ম আর মন্দ্ররাচ বুঝলেন, যে ওই থলেতেই আছে উটননির আবিষ্কৃত আসল জিনিষটি। 

আলিঙ্গন-পর্ব শেষ হতেই হম্মদ্ম হেসে বললেন “আমি আন্দাজ করেছিলাম আপনি আসবেন উপাচার্য”।
অশীতিপর বৃদ্ধও ম্লান হাসলেন, বললেন “আমার মেরুদণ্ড এখনও দৃপ্ত রয়েছে হম্মদ্ম। আপনাদের এ মহাযাত্রা শুরুর সময় আমি থাকবো না?”

সাজিস শান্ত মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, আলোয়ানে তার মুখ অর্ধেক ঢাকা। তার স্বভাব-গম্ভীর স্বরে তিনি বললেন “আর বিলম্ব কেন। ভোর হতে অল্প সময়ই রয়েছে”।

“সামান্য কিছু আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে সাজিস”, উপাচার্য রন্দ্রের কণ্ঠে মাপা উৎকণ্ঠা, “বন্ধুরা। হম্মদ্ম, মন্দ্ররাচ,সাজিস; পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মগজ ও হৃদয়ের ওপর অধিকার আপনাদের। উটননি, আপনিও এই চিরশ্রেষ্ঠ মানব প্রচেষ্টার সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত, বয়েসে নবীন হলেও গুণাবলীর বিচারে আপনি এখানে উপস্থিত কারোর চেয়ে সামান্যও কম নন। আপনাদের এ প্রচেষ্টার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকতে পেরে, এ বৃদ্ধ গর্বিত”। 

“উপাচার্য, আপনিই আমাদের মার্গ-দর্শক”, কাঁপা স্বরে বলে উঠলেন মন্দ্ররাচ।
“মার্গ-দর্শক আর হতে পারলাম কই মন্দ্ররাচ, হতে পারলে আজ তোমাদের পথ আলাদা হত না”, নিস্তেজ সুরে বললেন উপাচার্য।
“লক্ষ কিন্তু এক উপাচার্য। আর সম্ভবত এমন ভিন্ন পথে এগোনোর পন্থাই শ্রেষ্ঠ”, সাজিস শান্ত ভাবে বললেন।

“হয়তো”, মাথা নাড়লেন উপাচার্য, “হয়তো তাই সাজিস। আমি আন্তরিক ভাবে আশা করি যেন তাই হয়। বন্ধুরা, সময় অল্প। আমার যা বলার, শীঘ্র তা বলে ফেলতে হবে। যা যা বলতে চাই, সেগুলো হয়তো ইতিমধ্যে আপনাদের অনেকবার বলেছি। কিন্তু আজ আবার ঝালিয়ে নিতে চাই। আর কিছু নির্দেশ দেওয়ার আছে। উটননির হাতে আপনাদের সঁপে দেওয়ার আগে সেগুলো বলে দেওয়া দরকার”।

উপস্থিত সকলে আগ্রহের সঙ্গে উপাচার্যর দিকে তাকালেন। অন্ধকারেও তার চোখের ঝিলিক স্পষ্ট।

“আজ থেকে প্রায় সাড়ে-ছয় হাজার বছর আগে পৃথিবীতে মানব সভ্যতার পথ চলা শুরু। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষে নিজের উদ্যোগে পথ চলা শুরু করেছে, নতুন দিগন্ত আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এত চেষ্টা সত্ত্বেও, আমাদের প্রগতি শম্বূকগতিতে হয়েছে বললেন বাড়িয়ে বলা হবে। ছয় হাজার বছর বন্ধুরা। অথচ আমাদের চাষাবাদের প্রযুক্তি গত আড়াই হাজার বছরে তেমন পাল্টায়নি। পদার্থ বিজ্ঞানে আমাদের প্রচলিত ধারণাগুলো যে কত বালখিল্য তা না হয় আর আলোচনা নাই করলাম। জ্যোতির্বিজ্ঞানেও আমরা অথৈ জলে। ঘটনা চক্রে, আমরা যে তিমিরে আজ থেকে দু’হাজার বছর আগে ছিলাম, তার চেয়ে বিশেষ বড় কোন রদবদল আজও হয়নি। আগুন জ্বালতে শিখেছি, ধান-গম-ভুট্টা ফলাতে শিখেছি, কাপড়ে সামান্য জেল্লা এসেছে আর চাকার ব্যাবহারটুকু জানি। ব্যাস। এই নিয়ে কেটে গেল ছয় হাজার বছর”, একটানা বলে থামলেন বৃদ্ধ রন্দ্র।

“উপাচার্য”, উসখুস করছিলেন উটননি, “সময় বেশি নেই। তাছাড়া এসব কথা জেনেই তো আমরা...”

“তবু বলা দরকার উটননি”, সমাহিত কণ্ঠে বললেন উপাচার্য, “কারণ আমি জানি আমার বন্ধুদের মনে সমস্ত সন্দেহের নিরসন এখনও হয়নি। কী হম্মদ্ম, ভুল বলছি কী?”

“সন্দেহ কী বলছেন উপাচার্য”,হাত কচলে বলে উঠলেন হম্মদ্ম, “আমরা নিশ্চিত প্রকল্পের ব্যাপারে। শুধু ভাবছিলাম, আপনি এই যে বিজ্ঞানের অগ্রগতির কথা বললেন, তার সঙ্গে আধ্যাত্মবাদের কী সম্পর্ক... কারণ উটননি ছাড়া আমরা তো কেউই বিজ্ঞানের পসরা সাজাবো বলে এ যাত্রায়...”

“আধ্যাত্মবাদ আত্মস্থ না হল কোন জাতি শান্ত সমাহিত ভাবে প্রগতিকে আহ্বান করতে পারে না হম্মদ্ম। আধ্যাত্মবাদ থেকেই সাহিত্যের জন্ম, কাব্যের শুরু, প্রেমের জয়যাত্রা আরম্ভ। আধ্যাত্মবাদেই যুক্তিবাদীতার বীজ লুকিয়ে, আর যুক্তিবাদই বিজ্ঞান ও প্রগতির অন্তরাত্মা। আর সেখানেই আমরা সমগ্র একটা জাতি হিসেবে ব্যর্থ হতে চলেছি। পৃথিবীকে ব্যর্থ করতে চলেছি। অধ্যাত্মবাদের লেশমাত্র আমারা নিজেদের মধ্যে এই ছয় হাজার বছরে জাগিয়ে তুলতে পারিনি। হাজার হাজার বছরের মানব সভ্যতার এই পথ চলায় আমরা এখনও ধর্মের মুখোমুখি হইনি। কখনও কোন যুগপুরুষ তেমন কথা বললেও আমরা লিপ্সার লকলকে তলোয়ারে তাঁদের হত্যা করেছি। বেহিসাবি অসভ্যতা এখনও আমাদের মজ্জায়। আমাদের কোন আইন নেই কারণ আমাদের ভিতরে যুক্তিরসের কোন যোগান নেই। আমাদের অন্তরে জ্ঞান আরোহণের সামান্যতম সদিচ্ছাও নেই কারণ এ ছয় হাজার বছর ধরে আমরা উন্মত্ত হয়ে কাটিয়েছি, ফসল ফলিয়েছি, খেয়েছি, জন্মদান করেছি, খুন করেছি। ব্যাস। ছয় হাজার বছরের মানব সভ্যতায় আমাদের এ কোবাগী বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এক মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। ভাবতে ঘৃণা হয় না? অসহায় লাগে না? একমাত্র কোবাগী উপাচার্যরা নিরলস ভাবে চেষ্টা করে গেছেন আধ্যাত্মবাদ প্রচারের, বিজ্ঞানের প্রচারের। এতদিন পর্যন্ত কোন উপাচার্য তেমন সাফল্যের মুখ দেখেননি কারণ তাঁদের কাছে আপনাদের মত মহৎ প্রাণ ছাত্ররা ছিলনা। আমি ধন্য আপনাদের পেয়ে”, সামান্য থমকে ফের বলা শুরু করলেন বৃদ্ধ,  “আমরা আজ পর্যন্ত যেভাবে চলেছি, সেভাবে চললে মানবজাতির অন্ধকারে বিলীন হয়ে যেতে আর বেশি দিন নেই। উটননি এ জমায়েতে সর্বকনিষ্ঠ। তবে উটননির মত ক্ষণজন্মার সঙ্গে নিজেকে জুড়তে পেরে আমি আপ্লুত বোধ করছি। উটননিই আমাদের সক্কলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে আমরা মানুষরা আসলে বিজ্ঞানের অন্তরাত্মাকে স্পর্শই করতে পারেনি, পারলে আমাদের সভ্যতার ইতিহাস হত অন্যরকম। তবে গত বারো বছরে এ সমস্ত কিছু পাল্টে গিয়েছে উটননির নিরলস গবেষণায় এবং একের পর এক যুগান্তকারী সমস্ত আবিষ্কারে। সে সব আবিষ্কারের কথা বলা এখন নিষ্প্রয়োজন, সেসবের ব্যাপারে আপনারা সকলেই অবগত আছেন। কিন্তু কোবাগী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সে সমস্ত আবিষ্কারের কথা আমরা গোপন রেখেছি কারণ মানবজাতি এখনও সে আবিষ্কারগুলোকে আত্মস্থ করার জায়গায় আসতে পারেনি।কারণ আত্ম-উপলব্ধি, ধর্ম বিশ্বাসের উন্মেষ ও আধ্যাত্মিক স্থিতধীর যে সমস্ত স্তর পেরিয়ে এসে মানুষ বিজ্ঞানের উন্মত্ত ষাঁড়টিকে বাগে আনার জন্য প্রস্তুত হয়, তার কোনটাই আমরা সামগ্রিক ভাবে জাতি হিসেবে করতে পারিনি। অতএব আমরা প্রগতির জন্যেও প্রস্তুত নই, এক গাদা নতুন প্রযুক্তি ও আবিষ্কার আমাদের গলা দিয়ে গুঁজে দিলে আমাদের বমি করে ফেলতে হবে”, উত্তেজনায় হাঁপিয়ে উঠছিলেন উপাচার্য, “উটননি যে সব নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছে তার জন্য আমরা আগামী হাজার বছরেও প্রস্তুত হব না। আর সেখানেই আপনাদের বিশেষ ভূমিকা; মন্দ্ররাচ, হম্মদ্ম আর সাজিস। কিন্তু আপনাদের বিশেষ নির্দেশগুলো দেওয়ার আগে, উটননি বলো, তোমার যন্ত্রটা তৈরি ?”

উটননি নিজের গায়ের আলোয়ানটা সামলে নিয়ে পাশের অল্প বয়েসি ছেলেটিকে ইশারা করলেন থলে থেকে কিছু বার করতে। সকলের দিকে তাকিয়ে বললে “এ আমার খুড়তুতো ভাই, পুরো নাম নইনইআস্টে, ডাকনাম নইনই। নইনই গত পাঁচ বছর ধরে কোবাগী তে আছে। এখনও নিচু স্তরে অধ্যয়নরত হওয়ায় হয়তো আপনারা আলাদা করে চেনেন না। তবে বেশ বুদ্ধিমান ছেলে। আমাকে বেশ সাহায্য করে”।
ততক্ষণে নইনই ঝোলা থেকে একটা কালো পাথরের সাদামাঠা একটা গামলা বের করেছে। বেঢপ বড়। গামলার গায়ে বেশ কিছু সাদা নীল বোতাম আঁটা।

“এই সেই যন্ত্র?”, মন্দ্ররাচের কণ্ঠে স্পষ্ট ধন্দ।

“আজ্ঞে”, সপ্রতিভ সুরে বললে উটননি, “সময়ের এ পার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্যে। এর নাম দিয়েছি সময়িক। সময়িকের ভেতরে দু’পা পেতে সহজে দাঁড়ানো যায়; যে সময়ের অন্য প্রান্তে যেতে চায়, সে ভিতরে দাঁড়াবে। আর তার আগে সময়িকের গায়ে লাগানো বোতামগুলো দিয়ে দু’টো জিনিষ ঠিক করে দিতে হবে। স্থান, অর্থাৎ অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ। আপনাদের চিন্তা নেই, সেটা আমি ঠিক করে দেব। আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে সময়, অর্থাৎ কোন সময়ে গিয়ে আপনি পৌছতে চান”। 

“ভবিষ্যতেও যাওয়া যায় নাকি?”, উৎসুক চোখে জানতে চাইলেন হম্মদ্ম।
“সময়ের যে কোন দিকে যাওয়া যায় হম্মদ্ম। শুধু আপাতত একটাই অসুবিধে। এ যন্ত্র আমি একটাই বানাতে পেরেছি। এবং সময়ের ওপারে আপনি যখন পৌঁছবেন, তখন এই সময়ক গামলা আপনার সঙ্গে আর থাকবে না। অর্থাৎ আপনি সময়ে এগিয়ে বা পিছিয়ে গেলে, আর পূর্বের সময়ে ফেরত আসতে পারবেন না”
       
  কয়েক মুহূর্তের নিদারুণ স্তব্ধতা উপস্থিত প্রত্যেককে বিঁধল, ভাগ্যিস ঢেউ ভাঙ্গার আওয়াজটুকু ছিল।
“আপনারা সকলে আপনাদের ভূমিকা স্পষ্টভাবে বুঝে নিয়েছেন, এ বিশ্বাস আমার আছে”, উপাচার্য রন্দ্র ফের বলতে শুরু করলেন, “এই যে হাজার হাজার বছর ধরে আমরা একটি সামগ্রিক সভ্যতা গড়তে ব্যর্থ হয়েছি তার মূল কারণ হচ্ছে অনুশাসনের অভাব, আধ্যাত্মিক ভাবে দিশেহারা সমাজ, ধর্মহীনতা। এ সবকিছু ছাড়া বিজ্ঞানকে বরণ করতে যাওয়া আর ছয় মাসের শিশুর হাতে ধারালো ছুরি তুলে দেওয়া একই ব্যাপার। হম্মদ্ম, সাজিস আর মন্দ্ররাচ; আপনাদের সময়ের পাল বেয়ে ফিরে যেতে হবে। নিজেদের জ্ঞানের প্রদীপখানি কোবাগীর অন্তরালে না রেখে,  আলোকিত করতে হবে সমগ্র সমাজকে, মানব ইতিহাসকে। মানুষকে ধর্মদান করবেন আপনারা। মানুষের  বুদ্ধিকে অন্তত হাজার বছর ধর্মবোধে না রাঁধলে তা বিজ্ঞানের পাতে পরিবেশনের যোগ্য হবে না। আপনাদের কর্ম সুযোগ্য ভাবে সম্পাদন হলে তবেই উটননি এই সময়ক যন্ত্রের হাত ধরে যাবে আজ থেকে ঠিক হাজার বছর আগে। আধুনিক বিজ্ঞানের বীজ বপন করতে। ততদিনে ধর্মের হাত ধরে পৃথিবীতে জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষ ঘটতে শুরু করেছে। ধর্মবিরোধী যুক্তিবাদিতাও ততদিনে সজোরে মানবসভ্যতার বুকে নেমে আসবে, জ্ঞানের জমি তাতে আরও উর্বর হবে, বিজ্ঞান ও প্রগতির জন্য আর ভালো ভাবে প্রস্তুত হবে। তবে এ সব কিছুর আগে আপনাদের আগে ধর্মকে স্থির ভাবে স্থাপন করে আসতে হবে মানব সমাজে ও মানব হৃদয়ে। পরতে পরতে মানব-ইতিহাসকে আমূল ভাবে পাল্টে দিতে হবে আপনাদের। পারবেন না বন্ধুরা?” বৃদ্ধের চোখ তখন চকচক করছে।

“নিশ্চয়ই”, একসঙ্গে গর্জে উঠলেন হম্মদ্ম, সাজিস আর মন্দ্ররাচ।
বৃদ্ধ উপাচার্যের মুখে উজ্জ্বল হাসি, তিনি বললেন ; “আমার স্থির বিশ্বাস, আপনারা পারবেন। তবে আমি খুশি হতাম যদি আপনারা এক সঙ্গে ধর্মস্থাপনের কাজে নামতেন”।
“আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেককে আন্তরিক সম্মান করি উপাচার্য”, নরম সুরে বললেন মন্দ্ররাচ, “তবে ধর্ম-স্থাপনের ব্যাপারে আমাদের পদ্ধতি একান্তই আলাদা”।

“উপাচার্য রন্দ্র, বোঝার চেষ্টা করুন”, বলতে শুরু করলেন হম্মদ্ম, “আমাদের পন্থাগুলো এতটাই আলাদা যে আদর্শ ধর্ম স্থাপনের জন্যে আমাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সময় লাগবে বলে আমরা মনে করি। মন্দ্ররাচ আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বের সময়ে গিয়ে ধর্মস্থাপন শুরু করতে চায়। সাজিসের ধারণা আজ থেকে তিন হাজার বছর পিছিয়ে গেলেই সে মানবজাতিকে আদর্শ ধর্মের পথে চালিত করতে পারবে। আমি যেতে চাই আজ থেকে দু’হাজার বছর আগে, আমার বিশ্বাস সেটাই আদর্শ সময়”।

“আচার্য”, এবার বলেন সাজিস, “আমাদের ধর্মমত সমস্তই আপনার কোবাগী থেকে আয়ত্ত করা আমাদের তিনজনের ধর্মমতের গন্তব্যও এক। পন্থা আলাদা হলে ক্ষতি কী? শ্রেষ্ঠ পন্থাই না হয় আদর্শ ধর্ম হয়ে টিকে থাকবে? বা কে বলতে পারে, এই তিন পন্থা মিলে নতুন কোন আদর্শ পথ বেরিয়ে আসবে না? তাছাড়া আচার্য, মানবজাতি যে ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে পৃথিবী জুড়ে, আমাদেরও বোধ হয় ছড়িয়ে যাওয়াটাই কর্তব্য”।

বৃদ্ধ আচার্য খানিকক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন “বেশ। আপনারা যুগ-শ্রেষ্ঠ। যেমনটি বলছেন, তেমনটিই হোক। একটা সতর্কবাণী আপনাদের গোচরে এনে দেওয়া আমার কর্তব্য; তাই বলি। আপনারা ইতিহাসে ফেরত যাচ্ছেন ধর্মবোধ রোপণ করে মানব সভ্যতার আদর্শ রূপে উন্মেষ ঘটাতে। সাবধান- ঈশ্বর বনে যাওয়ার লোভ যেন আপনাদের পেয়ে না বসে”।

মন্দ্রারাচ, সাজিস, হম্মদ্ম এক সুরে বৃদ্ধ আচার্যকে আশ্বস্ত করলেন।

“বেশ। সে কথাই রইল”, আচার্য রন্দ্রের গলায় এবারে কর্মব্যস্ততার আভাস, “উটননি, তুমি কবে যাবে ইতিহাসে?”
“আজ থেকে ঠিক হাজার বছর আগে”, চটপট উত্তর উটননির, “ততদিনে সভ্যতার প্রলেপ বিজ্ঞানের পথ প্রশস্ত করে দেবে বলেই আমার বিশ্বাস। আধুনিক বিজ্ঞান যাতে ডানা মেলতে পারে সেরকম যথেষ্ট রসদ আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে আমি ছড়িয়ে দেব। তার ওপর ভর করে তারাই উতরে দেবে মানবজাতিকে, আমি নিশ্চিত। আজকের এ পৃথিবীর চেহারা হবে উন্নততর”।   

“তথাস্তু, সে কথাই হোক। আদর্শ ধর্মস্থাপন করতে মন্দ্ররাচ ইতিহাসে প্রবেশ করবে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। সাজিস ইতিহাস প্রবেশ করবে আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে আর তুমি হম্মদ্ম;ইতিহাসে প্রবেশ করবে আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে। উটননি, তুমি ইতিহাসে প্রবেশ করবে আজ থেকে হাজার বছর আগে, আধুনিক বিজ্ঞানের বীজ বপন করতে”, হুড়মুড় করে বলে গেলেন উপাচার্য, “ইতিহাসের পাতায় তোমাদের এই আধুনিক নাম নিয়ে প্রবেশ করার কোন মানে হয় না। তোমাদের নতুন নাম আমি দেব। তোমাদেরই নামের থেকে নির্যাস নিয়ে। মন্দ্ররাচের নাম হোক রামচন্দ্র। সাজিস হোক জিসাস আর হম্মদ্ম হোক মহম্মদ। উটননি, তুমি হবে নিউটন,  কেমন?”

উপস্থিত সকলে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লে।

উটননি এগিয়ে এসে বললেন “তবে এবার যাত্রা শুরু হোক, সময়ক তৈরি রয়েছে”।
“তিষ্ঠ উটননি”, বৃদ্ধের মুখে ধারালো মিচকি হাসি, “আরও দু’জন তোমাদের সঙ্গে যাবে”
“ আর কারা উপাচার্য?”। উটননি সামান্য অবাক।

“অবাক হয়োনা উটননি”, হাসলেন উপাচার্য, “তোমার আয়ত্ত করা একটি বিশেষ বিদ্যা আমি নইনইআস্টাকে শেখাতে বলেছিলাম মনে আছে?”
“পরমাণু বিজ্ঞান আর আপেক্ষিকতা? নইনইআস্টাকে সে’সব আমি শিখিয়েছি বটে কিন্তু সে যে ভয়ানক বিদ্যা! সে বিদ্যার প্রয়োগে বিজ্ঞান যেমন এক লাফে বহু ধাপ এগিয়ে যেতে পারে, তেমনি পাল্টা আগুনে সমস্ত সভ্যতাকে ছারখারও করে দিতে পারে, নইনইআস্টার কী সেই বিদ্যার আদর্শ প্রয়োগের বিচার-বুদ্ধি থাকবে...”, অসহায় শোনালো উটননি কে।

“দেখো উটননি, ইতিহাস পাল্টানোর কাজ বিপদসংকুল। দু’য়ে দু’য়ে চারের অঙ্ক খাটবে না”, বৃদ্ধ আচার্যর চোখে তখন অচেনা আগুনে ঝিলিক, “আদর্শ ধর্মস্থাপন যদি ব্যাহত হয়, আধুনিক বিজ্ঞানের স্রোত যদি ভুলে খাতে বয়; মানব সভ্যতার রূপ তখন আধুনিক দানবের মত হবে; যা কিনা আজকের এই প্রগতিহীনতার চেয়েও বহুগুণ বেশি ভয়ঙ্কর। আর তখন প্রয়োজনে মানব সভ্যতাকে আগুনে ঝলসে শুদ্ধ করে নিতে হবে। আর সে কাজ করতে পারে একমাত্র পরমাণু বিদ্যা। নইনইআস্টা ইতিহাসে প্রবেশ করবে আজ থেকে সাতশো বছর আগে, আইনস্টাইন নামে। কী হে নইনইআস্টা, পারবে না?”
সরল হাসি হেসে ঘাড় নাড়লে নইনইআস্টা।

“কিন্তু উপাচার্য রন্দ্র, শুধু বিজ্ঞানের জ্ঞান নিয়ে পরমাণু বিজ্ঞান আর আপেক্ষিকতার সঠিক প্রয়োগ অসম্ভব। সঠিক প্রয়োগের জন্যে চাই দর্শন জ্ঞান ও নান্দনিক বোধের সমন্বয়, বিজ্ঞান মানেই অঙ্কের নিয়মে চলা নয় উপাচার্য। যে কারণে ও বিদ্যার প্রয়োগ আমি করার কথাও ভাবছি না। আর নইনইআস্টা এক গিয়ে তা প্রয়োগ করবে?”, বিহ্বল হয়ে বললে উটননি।

“নইনইআস্টা একা তো ইতিহাসে যাবে না হে উটননি”, উপাচার্যের মুখে তখন সেই চেনা হাসিটা, “ওর সঙ্গে আমি যাব। আমি নিজে ওর সঙ্গে একই সময়ে ইতিহাসে থাকবো। দর্শন-জ্ঞান আর নান্দনিক বোধের আদানপ্রদান আমি করব ওর সঙ্গে। এখনও তোমার চিন্তা রয়েছে কি ?”

আনন্দে উপাচার্যকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন উটননি।
“ইতিহাসে আপনি কী নামে প্রবেশ করবেন উপাচার্য?”, পাশ থেকে সরল প্রশ্ন ভাসিয়ে দিল নইনইআস্টা।
“আমার নামটা যে বড়ই খটখটে যে নইনইআস্টা। শ্রীযুক্ত থনাবী রন্দ্র।কী হতে পারে এ নাম নিয়ে বলো দেখি?”, উপাচার্য হেসে প্রশ্ন করলেন।

“রবীন্দ্রনাথ”, নিশ্চিন্তে বলে উঠলে নইনইআস্টা।        
  
      

3 comments:

Kuntala said...

প্লট তো যথারীতি অভিনব বটেই, আমার লেখাটাও বড় ভালো লেগেছে।

malabika said...

প্লটের কথা তো হলই, নামের মুন্সিয়ানা? সত্যিই চমৎকার।

amit said...

Sese naamgulo kholsa kore bolar ki khub dorkar chilo?pathok k otuku vebe nite dao.silpo ke grahon korar janya moner o jogyata thaka dorkar.ranna koro,khaie dio na.