Skip to main content

লজ্জা



এই একদিন স্কুলে গেলাম। স্কুল বাসে। পিঠে ব্যাগ। ব্যাগে বই। খাতা। অসম্পূর্ণ হোম-ওয়ার্ক। ক্লাস টেস্টের মৃদু ভয়। সাদা জামা, নীলচে কালো প্যান্ট। টিফিনে চিড়ের পোলাও, সাথে একটা মিষ্টি। দেবরাজ, সৌরভদের সাথে টিফিনে ক্রিকেট। হা হা হি হি। গ্রামার ভুল করায় সুব্রত স্যারের কাছে রাম-বকুনি। সব ঠিক। শুধু ফেরার সময় স্কুল বাসের বদলে অ্যাম্বুলেন্স। অবশ্য অ্যাম্বুলেন্সের আর কোনও প্রয়োজন ছিল না। ক্লাস সেভেনের ছেলে এমনিতে যতই বিচ্ছু হোক, মাথায় বুলেট খেয়ে তো সে আর তম্বী করতে পারে না।

আমি অমন দুম করে ডেডবডি হয়ে বাড়ি ফিরলে কেমন হত? আমার বাবাটা কেমন যেন হয়ে যেত। কান্না ভদ্রলোকের সহজে আসেনা। প্রবল দুঃখে গলাটা কখনও বেঢপ ভারী হয়ে পড়লেও পর মুহূর্তেই সামাল দিতে পারতো। তবে আমি এমন ঝুলিয়ে দিলে আর নিজেকে হয়তো ম্যানেজ করতে পারবে না। মাংসে আগুন-রাঙা লোহার শিক ঢুকিয়ে দিলে যেমন গনগনে যন্ত্রণা তেমনটি টের পেতেন। ধরা যাক আমি তখন ক্লাস সেভেনে, তার মানে বাবার বয়স তখন মোটামুটি একচল্লিশ। অমন মাংসকাটা যন্ত্রণা নিয়ে আরও বছর তিরিশেক বাবাকে কাটাতে হত। বাবা কম কথার মানুষ। ধিকিধিকি অন্তরে মরতেন। বাবা চাইতেন আমি যেন অঙ্ককে ভয় না পাই। বাবা সেদিন থেকে আমায় ভয় পেতে শুরু করতেন, আমার স্মৃতি আগলে থাকা প্রত্যেকটি জিনিষপত্রকে দেখে আঁতকে ওঠা শুরু করতেন। অথচ বাবার চারদিকে আমার স্মৃতি। আমার স্কুলের জুতো, আমার ভিডিও গেমের বাক্স, বিশ্রী হাতের লেখায় ভরা খাতা, অ্যালবামের ছবি; সমস্ত বুকে জড়িয়ে বাবা ছটফট করতেন খাটের ওপর। বেকায়দা বলি হওয়া পাঁঠার মত সে ছটফট। বাবার স্বপ্ন, বাবার গত বারো বছরের বেঁচে থাকা, সঞ্চয়, ভবিষ্যতের সমস্ত প্ল্যানিং শেষ। বাবা শেষ। বাবার শুধু খোলসটা পড়ে থাকতো।

মার কষ্ট বাবার মত হত না।  পাথরের কষ্ট নেই। মা স্রেফ একটা পাথরে সেঁধিয়ে হারিয়ে যেত। আমার মাকে আর কেউ খুঁজে পেত না যদি আমি অমন ভাবে স্কুল থেকে ফিরতাম। মা জানতেন যে লাশ ফিরেছে সে তার বাবাই নয়। বাবাইকে মা নিজের হাতে স্কুলে পাঠিয়েছে। সে আসবে। মার্চে পুরীর টিকিট কাটা আছে। সে আসবে। মার চোখ নিশ্চল। মার মুখটা আমার বুলেট খাওয়া মাথার চেয়েও বেশি মৃত দেখাত।

আমার মা-বাবার বুকের তিন ইঞ্চি গভীরে ছুরি বেঁধানোর মামুলিতম উপায় হচ্ছে আমার আঙ্গুলের ডগায় ছুঁচ ছোঁয়ানো। আর আমার মাথায় জঙ্গির গুলি লাগলে আমার বাবা-মা’র কেমন লাগতো তা ঠাহর করার হৃদয় আমার নেই। ওপরের ভাবনাগুলো অপরিমিত আন্দাজ মাত্র।

আমার বাবা মা গতকাল পেশোয়ারের ঘটনাটা শুনেছেন। কারা এসে স্কুলে হামলা করেছিল, শ’খানেকের ওপর অসহায় নিরুপায় ছাত্র-ছাত্রী কে পরম শৌর্যের সাথে তারা খুন করে গেছে। বাবামা পাকিস্তান শুনতে পারেনি, ধর্ম শুনতে পারেনি, জেহাদ শুনতে পারেনি। ওরা বার বার শুধু এই ভেবে শিউরে উঠেছেন যে আমিও এমন ভাবে একদিন স্কুল থেকে নাও ফিরতে পারতাম।

এ ব্যর্থতা নিখুঁত ভাবে সামগ্রিক। এ ব্যর্থতায় সক্কলে রয়েছেন। আমি, আপনি, পাকিস্তান, বলিভিয়া, সুইজারল্যান্ড, মহম্মদ, বুদ্ধ, রাম, নিউটন, আইনস্টাইন, কপিলদেব, মারাদোনা, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, হিটলার, তালিবান, কৃত্তিবাস; সক্কলে। আমাদের প্রতিটি আবিষ্কার, প্রতিটি অভিযান, প্রতিটি কবিতা আজ নিশ্চিত ভাবে জলে। আমরা, মানুষরা, স্কুলের মধ্যে কচি পড়ুয়াদের গুলিতে নিকেশ না হওয়ার অধিকারটুকু দিতে পারিনি। কিনিয়ার কোন স্কুলেও যদি একটি মাত্র ছাত্রী জঙ্গিগুলিতে মার যায়, সে ব্যর্থতা সমস্ত ইতিহাসের।

সোজা ভাষায়, এটা আমার ডাইরেক্ট ফেলিওর। এই পচন ধরা ইতিহাসের শরীরের একটা পরমাণু হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে বড় লজ্জা আর কিছু হতে পারে না। এ শুধু পাকিস্তানের লজ্জা নয়।   

Comments

আপনার লেখা মাঝে মাঝে পড়ি। ভালো লাগে, কিন্তু কোনদিন কিছু বলিনি।
আজ বলছি। ভালো লিখেছেন।
fisfas said…
কি বলি বলো তো... তা এবারে বাপু তুমি ছড়াও নি। সবাই মিলেই ছড়াচ্ছি...
Srimanti said…
Ki bolbo janina. chokh bhijlo. Arekbar. Ma babar kotha bhebe aar nijer sontaner dike takiye
malabika said…
লজ্জা? কিসের জন্য? বরং ক্রোধ ছড়াও। ক্রোধের আগুনে ভস্মীভূত হোক নওয়াজ শরিফ আর তার দলবল, যারা দিনের পর দিন সন্ত্রাসবাদকে বিভিন্ন উপায়ে লালিত করেছে, আর সেই দৈত্যকে ঠেলে দিয়েছে পড়শি দেশের দিকে অশান্তি বাধাবার জন্য। কিন্তু কথা আছে না, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। সেটাই আজ সত্য প্রমাণিত হল। সন্ত্রাসবাদী সন্তানদের আগে এই পিতৃকুলের বিচার হোক ভয়ংকর যুদ্ধাপরাধীদের মত। বছরশেষে বাকি পৃথিবীকে এইরকম মর্মান্তিক ঘটনা, হাহাকার, বুক ভাঙা যন্ত্রণা, শুধুই কান্না উপহার দেওয়া কি জঘন্য অপরাধ নয়?

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু