Skip to main content

বিকেল আর বিভূতিভূষণ

শেষ শব্দটা লিখে হাঁফ ছাড়লেন বসন্ত। লাল মলাটের ডায়েরীটা বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। উত্তরের জানলাটা বন্ধ ছিল, খুলে দিলেন। মাঝরাতের তিরতির করে বয়ে আসা হাওয়া তার মুখে। বুঝলেন যে দশ বাই বারোর এই ঘরটা কতটা গুমোট হয়ে এসেছিল। ফতুয়ার ওপরের বোতামটা খুলে দিলেন- আহ:।
এক গেলাস জল গড়িয়ে খেলেন। ডায়েরীটা খুলে ফের পড়লেন শেষ পাতাটা, তার লেখা প্রথম উপন্যাসের শেষ কয়েক লাইন। তিনটে হালকা সবুজ রঙের ডায়েরী আর তেরোটা বছর জুড়ে লেখা।
“বিকেল আর বিভূতিভূষণ”। বুকের ভিতরে সহজ ধড়ফড়। ভালো লাগা। ফাঁকা ফাঁকা আনন্দ। শুরুটা হয়েছিল কলেজ স্কোয়ারের বেঞ্চিতে বসে। নিভার সাথে আলাপ তখন নতুন। ওর অপেক্ষাতেই বসে বসে একটা খামোখা প্লট মাথায় আসে। এ উপন্যাসের সাথে অবিশ্যি সে প্লটের কোন মিল নেই। হাসি পেল বসন্তর।

**

-   হ্যালো।
-   নিভা, এই আই অ্যাম ভেরি সরি...
-   কতবার বলেছি এত রাত্রে ফোন না করতে...
-   আমি রিয়েলি সরি। আসলে এত আর্জেন্ট একটা ব্যাপার...
-   আর্জেন্ট ব্যাপার মনে হলেই রাতবিরেতে আমায় ফোন করবে সেটা তো আর ঠিক নয় বসন্ত।
-   প্লিজ নিভা...
-   আমি এখন কথা বলতে পারবো না। নিখিল জেগে যাবে।
-   নিখিলবাবু কী মাইন্ড করেন...ইয়ে মানে...আমি ফোন করলে?
-   আমার প্রাক্তন স্বামী মাঝরাতে আমায় ফোন করবেন, আর আমার বর্তমান স্বামী সেটা এন্টারটেইন করবে। সেটা কী স্বাভাবিক বসন্ত? তোমার এখন সংসার নেই, তোমার এসে যায় না কিছু...
-   নিভা। দু’মিনিট। প্লিজ।
-   কী ব্যাপার।
-   লেখাটা শেষ হয়েছে।
-   হোয়াট?
-   উপন্যাসটা।
-   বিকেল আর বিভূতিভূষণ? রিয়েলি?
-   রিয়েলি। দারুণ না?
-   তুমি পারো বটে। অমিয়কে মারলে না রাখলে?অমিয়ই তো, প্রটাগনিস্ট?
-   ঠিকই মনে রেখেছ। নামটা প্রথমে অমিয়ই রেখেছিলাম। পরে নামটা কেমন ম্যানতা মারা লাগায়   পালটে নিয়েছি। তবে থাকছে সে। তুমি দেখো পড়ে...
-   দেখবো। ছাপবে কে?
-   নীলোৎপলবাবু অ্যাসিওর করেছে।
-   নীলোৎপল বটব্যাল? এটর্নিটি প্রেস? দেখো বাপু। ভদ্রলোককে ভারি ঘোড়েল মনে হয় আমার। সে কী এখনও তোমার হুইস্কি সঙ্গী নাকি বসন্ত?
-   ওই। কখনও-সখনও আর কী।
-   এবার আমার রাখতে হবে বসন্ত। নিখিল জেগে গেলে...
-   সরি নিভা। মানে, এ ব্যাপারটা কাকে বলবো বুঝতে না পেরে তালগোল পাকিয়ে তোমায় কল করে ফেললাম। আসলে এতদিন ধরে এটা শেষ করার চার বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছি... হঠাৎ একটা দুর্দান্ত সেন্টিমেন্ট এমন ভাবে...
-   আই নো বসন্ত। আমার খুব ভালো লাগছে। অল দ্য বেস্ট। এবার রাখি। গুড নাইট।
-   গুড নাইট নিভা। ধন্যবাদ।
-   ঘুমোও বসন্ত। ঘুম আসবে তোমার আজকে? নাকি ছাতে গিয়ে পায়চারি করতে হবে?
-   হে: হে:। দেখি। আসলে শেষ পাতাটা যদি তোমায় পড়াতে পারতাম, ভালো লাগতো...
-   গোটা উপন্যাস না পড়ে একেবারে শেষের পাতা শুনবো?
-   জাস্ট ফ্লেভারটার আইডিয়া দিতে। তাছাড়া এ তো আর সাসপেন্স থ্রিলার নয়...
-   আমার সত্যিই শোনার সময় নেই এখন বসন্ত। এক কাজ কর। ডায়েরীর শেষ পাতাটার ছবি মোবাইল ক্যামেরায় তুলে আমায় হোয়াট্‌সঅ্যাপে পাঠিয়ে দিও কেমন? আমি কাল সকালে পড়ে জানাবো। ওকে?
-   থ্যাঙ্ক ইউ নিভা।
-   টেক কেয়ার।

**


-   দুর্ঘটনার আগে বসন্তবাবু শেষ ফোনটা আপনাকেই করেছিলেন নিভাদেবী। ওর মোবাইল রেকর্ড তাই বলছে। এবং সেটা মাঝরাতে। কী এমন দরকার পড়েছিল?
-   ও একটা উপন্যাস লিখছিল। দশ বারো বছর ধরে। গতকাল রাত্রে সেটা শেষ করেছিল। ওর ইচ্ছে হয়েছিল সে ঘটনাটা আমাকে জানাবার। তাই...
-   আপনাদের তো ডিভোর্স হয়ে গেছিল...
-   দ্যাট্‌স রাইট অফিসার। পাঁচ বছর আগেই। তবে আমাদের কথা হত।
-   আপনার বর্তমান স্বামী সেটা জানতেন?
-   সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ওর উপন্যাস লেখা তিনটে হালকা সবুজ মলাটের ডায়েরী কি পেয়েছেন অফিসার?
-   উপন্যাস-টুপন্যাস জানি না। তবে তিনটে ডায়েরী আধ পোড়া অবস্থায় আমরা পেয়েছি ওর ব্যালকনিতে। ভেতরের কাগজ প্রায় বেশির ভাগই পুড়ে ছাই। শুধু মলাটের কিছু বেঁচে যাওয়া অংশ থেকে মালুম হয় যে তিনটি ডায়েরী ছিল, মলাটের রঙ সম্ভবত সবুজ ছিল।     
**


নিভা যখন বসন্তর ফ্ল্যাটে পৌঁছল তখন বেলা একটা। ফ্ল্যাট তখনে প্রায় পুরোটাই ঝলসে গেছে, চারিদিকে পোড়া গন্ধ আর ছাই। দমকল তার কাজ মিটিয়ে চলে গেছে। ফ্ল্যাট তখন পুলিশের কবলে। বসন্তর দগদগে মৃতদেহটা এক কোণে সরানো। দম বন্ধ হয়ে আসছিল নিভার। নিজের প্রথম সংসারের আঁশটে গন্ধে।
তদন্তরত পুলিশ অফিসার নিভার দিকে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিলেন।
-   আপনিই কী...?
-   নিভা দত্ত। বসন্তবাবুর প্রাক্তন স্ত্রী।
-   দুর্ঘটনার আগে বসন্তবাবু শেষ ফোনটা আপনাকেই করেছিলেন নিভাদেবী। ওর মোবাইল রেকর্ড তাই বলছে। এবং সেটা মাঝরাতে। কী এমন দরকার পড়েছিল?
-   ও একটা উপন্যাস লিখছিল। দশ বারো বছর ধরে। গতকাল রাত্রে সেটা শেষ করেছিল। ওর ইচ্ছে হয়েছিল সে ঘটনাটা আমাকে জানাবার। তাই...
-   আপনাদের তো ডিভোর্স হয়ে গেছিল...
-   দ্যাট্‌স রাইট অফিসার। পাঁচ বছর আগেই। তবে আমাদের কথা হত।
-   আপনার বর্তমান স্বামী সেটা জানতেন?
-   সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ওর উপন্যাস লেখা তিনটে হালকা সবুজ মলাটের ডায়েরী কি পেয়েছেন অফিসার? ওর ব্যালকনির কোণে? আধ-পোড়া অবস্থায়?
-   আপনি কী করে জানলেন যে ডায়েরীগুলো ব্যালকনিতে পোড়ানো হয়েছে নিভাদেবী? হাউ অন আর্থ?
-   ডায়েরীগুলোর সবটুকুই পুড়ে গেছে অফিসার?
-   কয়েকটা পাতা রিকভার করা গেছে বোধ হয়...অ্যাই পাণ্ডে...উও ডায়েরী কা বচা-খুচা পাতা ম্যাডামজী কে পাস লেকে আও...

**

প্রায় ছাই হয়ে যাওয়া ডায়েরীগুলোর মধ্যে থেকে, অদ্ভুতভাবে, গতকাল বসন্তর হোয়াট্‌সঅ্যাপ করা “বিকেল আর বিভূতিভূষণ”য়ের শেষ পাতাটা তখনও অক্ষত। পাতাটা ফের পড়লে নিভা :

" -  দুর্ঘটনার আগে বসন্তবাবু শেষ ফোনটা আপনাকেই করেছিলেন নিভাদেবী। ওর মোবাইল রেকর্ড তাই বলছে। এবং সেটা মাঝরাতে। কী এমন দরকার পড়েছিল?
-  ও একটা উপন্যাস লিখছিল। দশ বারো বছর ধরে। গতকাল রাত্রে সেটা শেষ করেছিল। ওর ইচ্ছে হয়েছিল সে ঘটনাটা আমাকে জানাবার। তাই...
-  আপনাদের তো ডিভোর্স হয়ে গেছিল...
-  দ্যাট্‌স রাইট অফিসার। পাঁচ বছর আগেই। তবে আমাদের কথা হত।
-  আপনার বর্তমান স্বামী সেটা জানতেন?
-  সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ওর উপন্যাস লেখা তিনটে হালকা সবুজ মলাটের ডায়েরী কি পেয়েছেন অফিসার?
-  উপন্যাস-টুপন্যাস জানি না। তবে তিনটে ডায়েরী আধ পোড়া অবস্থায় আমরা পেয়েছি ওর ব্যালকনিতে। ভেতরের কাগজ প্রায় বেশির ভাগই পুড়ে ছাই। শুধু মলাটের কিছু বেঁচে যাওয়া অংশ থেকে মালুম হয় যে তিনটি ডায়েরী ছিল, মলাটের রঙ সম্ভবত সবুজ ছিল।"

Comments

Partha Das said…
Very good. You should write longer stories.

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু