- হুঁ?
- বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস।
- এই বড়িটার নাম?
- আমার দেওয়া। লাতিন, প্রাচীন ইজীপ্সিয়, আধ-পুরনো জার্মান আর
ইনকা মেশানো নাম।
- মানে?
- কাঁচকলা।
- কাঁচ...?
- কলা।
- এ বড়ি খেলে হবে কি ?
- কাঁচকলা।
- অর্থাৎ?
- কিস্যু না। তাই কাঁচকলা।
- স্বাদ?
- স্বাদহীন।
- তবে লোকে এটা খাবে কেন?
- দুনিয়ায় কত বড়ি- ঘুমের বড়ি, সায়ানাইডের বড়ি,গর্ভ নিরোধক
বড়ি, হজমি বড়ি। সব বড়িতেই কিছু না কিছু হয়। এই আমার আবিষ্কৃত বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিসই
প্রথম বড়ি যা খেলে কিস্যুটি হয় না। ভালো মন্দ কিস্যু না। এক্কেবারে নিরেট কাঁচকলা।
উপকারও নেই, ক্ষতিও নেই। মধ্যম পথ। বুদ্ধ বেঁচে থাকলে নিজে এনডোর্স করতেন। উকিলবাবু,আপনাকে
হেল্প করতেই হবে।
- হেল্প? আমি ? মানে আপনি এই বেলু বড়ি কে পেটেন্ট করাতে
চাইছেন ডক্টর সামন্ত?
- বেলু বড়ি নয় উকিলবাবু। বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস। ট্যাগলাইনও
ভেবেছি। বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস- দ্য কাঁচকলা বড়ি। কেমন দাঁড়িয়েছে? কী?
- ধুর কাঁচকলা। এ বড়ি কেউ গিলবে কেন?
- দরকারি নয়, অদরকারিও নয়। এমন জিনিষ দুনিয়ায় কটা আছে
উকিলবাবু? উদাহারণ দিন দেখি।
- ঢের আছে।
- এনি টু এগজাম্পেলস্ প্লীজ।
- এই যে রাস্তার গাছপালা...
- কী বলছেন মশাই ? অক্সিজেন দিচ্ছে যে।
- রাস্তার পাথর?
- কোনওদিন হোঁচট খাননি?
- যাক গে। বাদ দিন। ফর্ম এনে দেব কালকে। আপনি ভরে দিয়ে দেবেন।
অ্যাপ্লাই করে দেখা যাক।
***
- ডক্টর সামন্ত।
- ইয়েস ইওর এক্সেলেন্সি...আই মিন হিজ হাইনেস...আই মিন...
- প্রাইম মিনিস্টার। পিএম বললেই হবে।
- ইয়েস জাঁহাপনা। আই মিন ইয়েস। ইয়েস। ইয়েস প্রাইম
এক্সেলেন্সি।
- আপনার বড়ি। ওই বেলুস্পি...স্পি...
- বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস।
- ওই পেটেন্ট ভারত সরকার অধিগ্রহণ
করতে চায়।
- পেটেন্ট অধিগ্রহণ?
- ভারতবর্ষ শুধু নয়, আপনার এই বড়ির
চাহিদা বিশ্বজুড়ে আগুনের মত ছড়িয়েছে। নির্গুণ এই বড়ির জন্যে লোকে হন্যে হয়ে ঘুরে
বেড়াচ্ছে। আপনার ওই ডানকুনির ছোট্ট কারখানার ক্যাপাসিটি আর কতদূর ?১০০% নির্গুণ এই
বড়ি মুখে দিয়ে মানুষ নিরন্তর সময় কাটাচ্ছে; অটো-বাসের লাইনে, সেলুনে রবিবারের
ভিড়ে। সেলফোনে ব্যাটারি না থাকলে বড়ি চুষতে চুষতে অপেক্ষা করছে কখন ফোন চার্জ হওয়া
শেষ হবে।এমনকি বৈজ্ঞানিক থেকে মন্ত্রী-আমলা; দৈনিক কর্মব্যস্ততার মাঝে সবার জন্যেই
জরুরি হয়ে পড়েছে এই বড়ি মুখে দিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়া। জিভও সচল থাকছে, অথচ স্বাদের
ঢেউ গিয়ে মগজকে বিব্রত করছে না। বা অস্বাস্থ্যকর খাদ্যকণাও কিছু রক্তে গিয়ে মিশছে না।
- সে তো বুঝলাম কিন্তু আমি...
- এর ডিমান্ড আর শুধু এ দেশে আটকে নেই ডক্টর সামন্ত । আমেরিকা ইউরোপ অস্ট্রেলিয়া থেকে
টন টন বড়ির ডিম্যান্ড আসছে এ দেশে। অথচ পেটেন্ট শুধু আপনার আছে বলে যথেষ্ট পরিমাণে
প্রোডাকশন নেই। ফলত অনেক পাইরেটেড বড়ি ফ্যাক্টরি গজিয়ে উঠেছে।
- বলেন কি স্যার ?
- রিয়েলি। আমাদের ইন্টেলিজেন্স তাই
বলছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিজে আমায় ফোন করে জানিয়েছেন এ বড়ির উৎপাদন সরকারি
ছত্রছায়ায় শুরু করতে পারলে খোদ আমেরিকা থেকে প্রতি মাসে তারা টনটন আমদানি করতে
রাজি আছে এই বেলু...বেলু...
- বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস।
- আম...আমে...আমে...
- আমেরিকা। ইয়েস।
- একটু জল স্যার।
- জল পরে খেলেও হবে। আগে শুনুন। ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়
রপ্তানির আধার হতে পারে আপনার এই বড়ি। আপনি এ বড়িকে ওই ডানকুনিতে আটকে রাখবেন না।
- আমি...? আটকে?
- শুনুন। এই বেলু...বেলু...
- বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস।
- হ্যাঁ এই বড়ি এবার থেকে ভারত সরকার ম্যানুফাকচার করবে। আপনি
পাবেন রয়্যালটি। অবিশ্যি তাতেই আপনি
কোটিপতি বনে যাবেন মাসখানেকের মধ্যে।
- ক্রোড়?
- অফ কোর্স। যাক গে। আমি বেঙ্গল
সি-এম’কে বলে দিয়েছি। ও আপনার সঙ্গে কোওরডিনেট করে নেবে। ওকে?
***
ডাক্তার সামন্ত সুইসাইড
পয়েন্টে এসে যখন দাঁড়ালেন তখন বিকেল পাঁচটা। উলটো দিকে প্যান্ডিমের চুড়োর গায়ে
লালচে গোলাপি মেশানো সন্ধ্যের আভা। পকেট থেকে বেণীমাধবের হাফ পঞ্জিকাটা বের করে
কনফার্ম করে নিলেন; আদর্শ সময় বিকেল পাঁচটা বেজে নয় মিনিট।
হু হু করে হিমেল
হাওয়া এসে কানে ঠেকছিল। মাফলারটা ভালো করে গলা কান দিয়ে পেঁচিয়ে নিলেন। দীর্ঘশ্বাস
ঘন হয়ে আসছিল তার বুকে। কী কুক্ষণেই না বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস আবিষ্কার করতে
গেছিলেন তিনি। কেনই বা পেটেন্ট করে ডানকুনির ফ্যাক্টরিতে বানানো শুরু করলেন। কেনই
বা প্রধানমন্ত্রীর কথায় নেচে বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস রপ্তানিতে সম্মত হলেন।কেনই
বা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এমন বড়ি রাক্ষুসে পরিমাণে আমদানি করার নির্দেশ দিলেন। নির্গুণ
কোন কিছুর ওপর যে মানুষের এমন অপরিসীম মোহ থাকতে পারে তা ভাবতেই পারেননি ডাক্তার
সামন্ত। সার বুঝ বুঝেছিলেন সিদ্ধার্থ। আর ঠেকে শিখলেন ডাক্তার সামন্ত।
কিন্তু সব শেষ।মানুষ
ভালো খারাপের দ্বন্দ্বে এমন বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল যে নির্গুণ এই বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস
কে পেয়ে তারা স্রেফ উন্মাদ হয়ে গেল। পাঁচ বছরের
মাথায় পৃথিবীর সত্তর শতাংশ সম্পদকে ভিড়িয়ে দেওয়া হল বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস
উৎপাদনে। একদিকে যেমন উপকার হল যুদ্ধ সরঞ্জামের উৎপাদন কমে গিয়ে, অন্য দিকে
মানুষের পাগলামি বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছল যে ক্রমশ জরুরি জিনিষপত্র বাদ দিয়ে শুরু
হল বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস উৎপাদন। লোহার কারখানা বন্ধ হয়ে শুরু হল বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস
কারখানা, আবাদযোগ্য জমিতে তৈরি হল নতুন বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস কারখানা। দশ হাজার
বছরের ভালো-খারাপের ইতিহাসে মানুষ এতটাই বিরক্ত হয়ে পড়েছিল যে নির্গুণ বড়ি বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিসের
বাণিজ্যিক আত্মপ্রকাশের পর থেকেই মানুষ এই কাঁচকলা বড়ির জন্য উন্মত্ত হয়ে পড়লো।
কিন্তু সমস্ত সম্পদ নির্গুণ উৎপাদনে ঠেলে দেওয়ায় যা হওয়ার তাই হল। যুদ্ধও এক ধরনের
ইকনমি, কিন্তু নির্গুণ বড়ি উৎপাদন যে ধ্বংস, তা মানুষ বুঝেও বুঝতে চাইলে না। পাঁচ
বছরের মাথায় শুরু হল খাদ্যাভাব। সে অভাব প্রচণ্ড- প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়; সমস্ত
বিশ্বের ব্যবধান গেল ঘুচে।
গত দেড় বছরে
পৃথিবীতে একশো তেরো কোটি লোক আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিসের
একটা কারখানাও বন্ধ হয়নি। ইন ফ্যাক্ট আত্মহত্যাকে বরং পৃথিবীর সমস্ত দেশেই
সাংবিধানিক মান্যতা দেওয়া হয়েছে। এ আর তেমন তাবড় কিছু নয়। এই ভারতবর্ষেই গড়ে উঠেছে
বিভিন্ন সরকারি সুইসাইড পয়েন্ট। এবং তার সবকটাই রমরমিয়ে চলেছে। ভারতবর্ষের
জনসংখ্যা এখন বাহাত্তর কোটিতে এসে ঠেকেছে।
মানবসভ্যতার এমন
ফিচেল আত্মসমর্পণ ভাবা যায় না। আর ডাক্তার সামন্ত জানেন দোষ অনেকটাই তার হুজুগের। ঘড়ির
দিকে তাকালেন। পাঁচটা নয় বাজতে আর তিরিশ সেকেন্ড।
***
- এজেন্ট বিস্প ?
- হুঁ?
- এজেন্ট বিস্প? আমাদের কথা শুনতে পারছেন ?
- আমি ? আমি কোথায়?
- আপনি এস্লনে ফেরত এসেছেন এজেন্ট বিস্প।
- মিশন ?
- সম্পূর্ণ সফল। আপনার কি কিছুই মনে নেই?
- পৃথিবীর মানুষ হয়ে পৃথিবীতে ল্যান্ড করার পর থেকেই আমার
মেমরি ওয়াইপ্ড আউট ছিল। আমি অটো পাইলটে ছিলাম, জানেনই তো।
- পৃথিবীতে আপনার লোকাল কোড নেম কী ছিল সেটা মনে আছে এজেন্ট
বিস্প?
- সেটুকু আছে। ডাক্তার সামন্ত, তাই না?
- ঠিক।
- মিশন কি অবস্থায় রয়েছে?
- গণ-আত্মহত্যার যে বহর আপনি সেখানে শুরু করে দিয়ে এসেছেন, আগামী
পাঁচ বছরের মধ্যেই পৃথিবীর বুক থেকে মানুষ প্রায় গায়েব হয়ে যাবে। তখন আর আমাদের
সকলের সেখানে চলে যাওয়ায় কোন বাধা থাকবে না। সেটা তখন আমাদেরই গ্রহ হবে। পৃথিবীর
নাম পাল্টে রাখা হবে এস্লন-২।
- বটে। কাঁচকলার বড়ির কী গুণ। কি নাম যেন দিয়েছিলাম তার? কি
বেলা...বেলি...বেলু...বেলুসি...বেলু কি যেন ?
- বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস।
- তাই তো। তাই তো। বেলুবিস্লিপুনিকাস্পেনিস। আচ্ছা। আমি ছাড়াও
আরও দুজন এজেন্ট এই মিশনের কাজে পৃথিবীতে গেছিল না? এজেন্ট ম্রিল আর এজেন্ট ইস্পের? তারা সেখানে কি ভূমিকায় ছিল?
- ও আপনি তো টের পাননি না। তারা দুজনেও এখন ফিরে এসেছেন।
এজেন্ট ম্রিল ছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আর এজেন্ট ইস্পের ছিলেন ভারতের
প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায়। আর কথা নয় এজেন্ট বিস্প। আপনার ওপর দিয়ে বিস্তর ধকল গেছে।
এখন বিশ্রাম করুন।
Comments