Skip to main content

গানের মানে



লিরিসিস্ট দত্তবাবু আত্মহত্যা করেছেন গতকাল। পুলিশ বলছে সোজা সাপটা আত্মহত্যার কেস। মিসেস্‌ দত্ত বলেছেন তার লেখা গানের কথার বাজার পড়তির দিকে থাকায় ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে।
সুইসাইড নোটে বেমক্কা গান লিখে গেছেন, নির্দিষ্ট কোন কারণ দেখিয়ে যাননি। কিন্তু বটু গোয়েন্দা তো আর সাধারণের দলে পড়েন না। সুইসাইডের নোটে লিখে যাওয়া গানখানা বার দুই পড়েই ইন্সপেক্টর সামন্ত কে সাইডে নিয়ে এসে বললেন-


-   “ইন্সপেক্টর সাহেব, মিসগাইডেড হবেন না। এটা আত্মহত্যা নয়। খুন”।
-   “খামোখা যাতা কথা কেন বলছেন বটুবাবু, কতবার বলেছি অকুস্থলে না বলে কয়ে এমন ভাবে এসে পড়বেন না”।
-   “ঠাণ্ডা মাথায় শুনুন আমি যা বলছি। তার আগে বলুন সুইসাইড নোটে গান লিখে যাওয়াটা একটু অদ্ভুত ব্যাপার নয় কী?
-   “দেখুন বটুবাবু, দত্তবাবু টালিগঞ্জের লিরিসিস্ট ছিলেন। শিল্পী মানুষ। শিল্পীদের মশাই অমন একটু বেখাপ্পা খেয়াল-টেয়াল হয়ে থাকে”।
-   “অবাক করলেন স্যার। এ চিঠি স্পষ্ট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে খুনি কে, আর আপনি সেটা ঠাহর করতে পারছেন না? এত সহজ কেস গুবলেট করলে লালবাজারে আপনার ইজ্জত আস্ত থাকবে ভেবেছেন?”।
-   “লে হালুয়া। স্পষ্ট চিঠি। ধুর। আমি তো ছাই কিচ্ছু বুঝলাম না”।  
-   “এবার মাথা ঠাণ্ডা করে আমার কথা শুনুন। চিঠিটা গোটাটা একবার মন দিয়ে জোরে জোরে পড়ুন দেখি”।
-   “ঠিক আছে। পড়ছি। আসছে এপ্রিলে আবার প্রমোশন ডিউ হচ্ছে। তার মাঝে এত হ্যাপা। ধুর। শুনুন।
চামচের ঠোঁটে লেগে থাকে শুকনো পাতার গান/ বোবা জলে ডুবে থাকে রাতে নীল সারসের চান/ সাদা বোরোলিনে আজ বার বার, মৃত ডেটলের সংসার/ ভেজা চুলে জুঁইফুলে আঁকা ভাঙা কাঁচেদের অভিসার/ টেলিফোনে চল মিস্‌ড কলে শুধু ভেজা আরসালান/ চামচের ঠোঁটে লেগে থাকে শুকনো পাতার গান। এটা কি হল? চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ”।
-   “স্পষ্ট। জলবৎ। চামচের ঠোঁটে লেগে থাকা শুকনো পাতার গান। দত্তবাবুর রান্নাঘরে গতকাল রাতের এঁটো বাসনপত্র ঘেঁটে দেখেছেন ইন্সপেক্টর সাহেব?”।
-   “এঁটো বাসন?”।
-   “ইয়েস স্যার। গতকাল রাত্রে ডিনারের পরে মারা যান দত্তবাবু। কেমন ?”।
-   “ঠিক”।
-   “গতকাল ডিনারে তিনি খেয়েছেন পালং শাকের তরকারি, শিঙ্গি মাছের ঝোল আর রুটি”।
-   “ই: ম্যাগো...”।
-   “গতকালের এঁটো বাসনের মধ্যে রয়েছে সেই চামচ যে চামচ দিয়ে তিনি পালঙের তরকারি গিলেছেন। এবং এ মুহূর্তে সে চামচে পালঙের সবজে রেশ লেগে শুকিয়ে আছে”।
-   “ওই পালং ঝোলে বিষ ? ওই চামচকে ল্যাবে পাঠাবো?”।
-   “ধুর মশাই। আগে শুনুন না। এর পরের লাইন। বোবা জলে ডুবে থাকা রাতে। হোয়াট ইজ বোবা জল?”।
-   “কী বলুন তো?”।
-   “জল কি কথা বলে?”
-   “কই না তো”
-   “বলে ইন্সপেক্টর সাহেব বলে। কাটাপোনার ঘি গরম মশলা দিয়ে ঝোল বা কচি পাঁঠার টানটান ঝাল দেওয়া ঝোল। সে ঝোল লিকুইড কিন্তু দে স্পিক। সে ঝোল জলের মতই তরল, অথচ আবেগের সাথে কথা বলে আমাদের হৃদয়ের সাথে।অর্থাৎ ঝোল হচ্ছে কথা বলা জল। ঠিক ? এবার ভাবুন। ট্যালট্যালে শিঙ্গি মাছের সাদাটে ঝোল! সেটা কি বোবা জল নয়?”
-   “তাই তো। ডাম্ব ওয়াটার। অফ কোর্স। এ তো জলের মত সহজ। কিন্তু ওই নীল সারস”।
-   “ওইখানে একটু হোঁচট খেয়েছিলাম বটে। ভেবেছিলাম ছন্দ মেলাবার খাতিরে ভদ্রলোক একটা যাতা কিছু মেরে দিয়েছেন আর কী। কিন্তু না। তলিয়ে দেখলে অন্য মানে আসছে। ওইখানেই মোক্ষম খেলে ঝেড়েছেন ভদ্রলোক। নীল মানে এখানে ইংরেজি নীল। এন আই এল। অর্থাৎ জিরো। গোল্লা। আর সারস মানে পাখি নয় স্যার। এখানে সারস হল সা-রস। সা মানে প্রথম সুর আর রস মানে অবভিয়াসলি আপনি জানেন”।
-   “সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে বটুবাবু”।
-   “মাথা ঠাণ্ডা করুন। এখানে ভাবুক মেজাজে দত্তবাবু জানিয়েছেন যে খাওয়াদাওয়াই জীবনের প্রথম সুর, সুখাদ্য থেকে রস আরোহণ করেই আমাদের জীবনধারণ। অর্থাৎ খাদ্যই হল সা-রস, অর্থাৎ জীবনের আদত সুর। অথচ রাতের পর রাত ট্যালট্যালে ঝোল খেয়ে অর্থাৎ বোবা-জল গিলে তাকে দিন গুজরান করতে হচ্ছে”।
-   “উরিব্বাস”।
-   “তবে আর বলছি কি ইন্সপেক্টর সাহেব। এরপরের লাইন বেশ সোজা। দত্তবাবুর ফ্রিজ থেকে গতকালের ভাত আর শিঙ্গি ঝোল বার করে অল্প চেখে দেখেছি। ও মশাই এক খাবলা বোরলিনে দু চামচ ডেটল মাখিয়ে খেলেও একই রকম লাগবে। আর এই ডেটল বোরোলিন খানাই তাকে এ সংসারে দৈনিক খেতে হত। দু বছর আগে তার আলসার ধরা পড়ে। সেই থেকে মিসেস্‌ দত্ত তার খাওয়াকে এমন ডেটল-বোরোলিন করে দেন”।
-   “ও মাই গড!’।
-   “মিস্টার দত্তর খাওয়াদাওয়া নিয়মে যতই বেঁধে দিন, মিসেস দত্ত নিজে কিন্তু যথেষ্টই খাদ্যরসিক আর খাওয়ার ব্যাপারে মোটেও বিশ্বাসী নন। বরং খাদ্যাত্মিক পরকীয়াতে তিনি রীতিমত লিপ্ত ছিলেন। সেটা টের পাওয়াতেই আর নিজেকে সামলাতে পারেননি দত্তবাবু। তাই ঘুমের ওষুধ খেয়ে এই যাচ্ছেতাই কাণ্ডটি ঘটিয়ে ফেললেন”।
-   “ দাঁড়ান দাঁড়ান মশাই। খাদ্যাত্মিক পরকীয়া? মিসেস দত্ত? হাউ ? মানে...”
-   “স্নান সেরে খোঁপায় জুঁইফুলের মালা লাগিয়ে ঘুরতে বেরোনো মিসেস দত্তর পুরনো অভ্যাস। ভাঙা কাঁচ বলতে মিস্টার দত্ত তার বৈবাহিক জীবনের কথাই বলেছেন; একসময় যা স্বচ্ছ কাঁচের মত ট্রান্সপারেন্ট ছিল। কিন্তু খাদ্যবিষয়ক অ্যাডালটারির ছোঁয়ায় যা আজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে চলেছে। অর্থাৎ ভেজা চুলে শুধু জুঁইফুলে ভাঙা কাঁচেদের  অভিসার। মিস্টার দত্তকে ফাঁকি দিয়ে মিসেস দত্ত নিয়মিত আরসালানে যেতেন নিজের বান্ধবীদের সাথে। বিরিয়ানি আর মাটন চাপের ফোয়ারায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে। কারণ বাড়িতে পালং শাক আর শিঙ্গির ঝোল তার মুখে রুচতো না। অথচ তিনি বিরিয়ানি খাচ্ছেন জানলে দত্তবাবু যে ভেঙ্গে পড়বেন সেটাও বুঝতেন তিনি। তাই বন্ধুদের সাথে আরসালানে মাঝে সাঝেই গাণ্ডেপিণ্ডে গিলতে যেতেন কিন্তু লুকিয়ে চুরিয়ে। মিসেস দত্তর বান্ধবীরা তাকে মিস্‌ড কলে মনে করাতেন আরসালান অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা”।
-   “আরিব্বাপরে। তাই এখানে বলছেন যে টেলিফোনে চল মিস্‌ড কলে শুধু ভেজা আরসালান”
-   “কারেক্ট। মিসেস দত্তর হ্যান্ড-ব্যাগ সকালে স্পটে পৌঁছেই হাতসাফাই করেছিলাম। সেখান থেকে গতকালের আরসালানের ফুর্তির রসিদ বেরিয়ে এসেছে। আর মিসেস দত্ত যখন নিয়মিত আরসালানে চিকেন ভর্তায় নিমজ্জিত, দত্তবাবু তখন দিনের পর বোবা জলে ডুবে রয়েছেন। অর্থাৎ পালঙের ঝোল গিলে দিন কাটাচ্ছেন। এবং সত্যটা যখন কোনভাবে দত্তবাবুর কাছে খোলসা হল, তখন আত্মহত্যা না করে বেচারির আর কোন উপায় ছিল কী? এটা কি জাস্ট একটা আত্মহত্যা ইন্সপেক্টর সাহেব? আপনিই বলুন না!”
-   “বোবা জলে ডুবা থাকা রাতে নীল সারসের চান। আহা, বুক ফেটে যাচ্ছে বটুবাবু। পুওর চ্যাপ। এ তো খুনের চেয়ে কিছু কম নয়”।                          


Comments

malabika said…
ডেটল আর বোরোলীনের কম্বিনেশনটা জাস্ট লা-জবাব। য়ার বাকি গল্পের বিশ্লেষণ? পড়তে পড়তে মাথাটা ঘেঁটে যাচ্ছিল। শেষে কিনা ট্যাল্‌টেলে ঝোল! হা ঈশ্বর।

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু