Skip to main content

নিত্যযাত্রী

" কেউ ক্রিকেট খেলেন, কেউ রাইটার্সে ফাইল-বাজি করেন, কেউ গীটার বাজিয়ে আহা-উঁহু করেন, কেউ ভোটে দাঁড়ান, কেউ টিউশনি পড়ান। আমি করি ডেলি-প্যাসেঞ্জারি। ওইটাই হল আমার প্রফেশন বুঝলেন", সন্ধ্যে ছটা দশের আপ বর্ধমান লোকালে সদ্য আলাপ হওয়া দিলীপবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আলাপের শুরু খবরের কাগজ আদান-প্রদান দিয়ে। দিলীপবাবুর কোথায় না হেসে পারলাম না।
- " হাসছেন দাদা ?", পকেটের রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন দিলীপবাবু, " আরে মশাই , " আমার তো মনে হয় মেমারি টু হাওড়াতেই জীবন বয়ে যাচ্ছে। সকালে দু বালতি জলে স্নান আর চাট্টি ডাল-ভাত, অফিসে দুটো ফাইল আর ওপরওয়ালার খিস্তি। ওদিকে বাড়ি ফিরে বাচ্চার ঘ্যান-ঘ্যান, গিন্নীর বায়না আর টেলিভিশনে গুলতানি। এ সব তো হুশ করে হাপিশ হয়ে যায়; কিন্তু প্রত্যেক দিন যেটা রয়ে যায় সেটা হচ্ছে সাড়ে দিন ঘণ্টার ট্রেন ঘষটানি। বুঝলেন ?"
- " বুঝলাম", বলতেই হল।
- " নো স্যার। বোঝা অত সহজ নয়। গত তেইশ বছর ধরে; ঝরে-জলে-রোদ্দুরে এই বর্ধমান লোকালের ঠিক এই কামরাটিতেই আমার দৈনিক সাড়ে তিন ঘণ্টা কাটে। এইটে হল আমার ড্রয়িং রুম; খবরের কাগজ পড়বার সোফা হচ্ছে এই কাঠের সিট। ক্লাবও বলতে পারেন- টুয়েন্টি-নাইন টু রামিও এইখানেই চলে। এইখানে আমার সোশ্যালিজম'য়ে হাতেখড়ি। কি ভাবে ? গত পনেরো বছর ধরে আমার ফিক্সড টুয়েন্টি নাইন পার্টনার হচ্ছে পল্টু- গড়িয়াহাটের মাছ-ওয়ালা। আর রামি'র পার্টনার হলে গিয়ে বড়বাজারের লোহার-কারবারি দেবকুমার দেব; হুগলী বর্ধমান মিলে যার একশো বিঘের ওপর জমি রয়েছে। তারপর ধরুন আমার ইয়ার-দোস্ত বলতে যারা সবাই ডেলি-প্যাসেঞ্জার। এই কামরাটাই আমার রক। সাহেব-সুবো'দের মত শরীর চাঙ্গা রাখতে আমায় জিমে ছুটতে হয় না; রোজকার ট্রেন-জার্নিতেই মেদ-টেদ ফস করে উড়ে যায়। আর নিজস্ব রুচি-টুচি গেছে বেদম চটকে"
- " রুচি চটকে গেছে মানে ?", গপ্প শুনতে মন্দ লাগছিলো না।
- " মানে এই ধরুন আলুর দমের থেকে সল্টেড বাদামে বেশি স্বাদ পাই। আমার শালাবাবু আসামের টী-এস্টেটের ম্যানেজার- তাঁর দৌলতে বাড়িতে হামেশাই এস্যাম টী'র ডিবে আসে। কিন্তু ট্রেনে দুলুনি বা মাটির ভাঁড় ছাড়া আমার মুখে চা রোচেনা। তা ছাড়া একটা অতি সাঙ্ঘাতিক অভ্যাসের কবলে পড়েছি মশাই"
- " কেমন সাঙ্ঘাতিক ?"
- " দাঁড়িয়ে ঘুমোবার"
- " মানে ?"
- " মানে হাওড়া যাওয়ার সময় রোজই বিদঘুটে ভিড়। বসার আশা তো দূর একপায়ে দাঁড়াতে পারলে সুবিধে হয়।তা সেই বিদঘুটে সময়টা কাটাতে আমি বিগত কুড়ি বছর ধরে ঘুমিয়ে আসছি; দাঁড়িয়ে। এক হাতে ট্রেনের হ্যান্ডেল, অন্য হাতে অফিস ব্যাগ আর চোখে ঘুম। ঝক্‌ঝকে আধ ঘণ্টা।
- " বলেন কি ? রোজ?"
- " ইয়েস স্যার। ইভেন অন সানডেইজ"
- " রোববারেও? কিন্তু রবিবার তো ছুটি ?"
- " আরে মশাই, জানি। কিন্তু অভ্যাস ভারি খতরনাক্‌ চিজ। দিনে আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে না ঘুমোলে আমার সুগার বেড়ে যায়, গা গুলোতে থাকে, মাথা ঝিম্‌ঝিম্‌ করে। অতএব, রবিবারগুলোতে যাতে কোনও ক্রাইসিস্‌ না হয়, তার জন্যে চিলে কোঠার ঘরের কড়িকাঠ থেকে একটা কাঠের হ্যান্ডেল ঝুলিয়ে নিয়েছি। স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানানো; অবিকল এই কামরায় যেমন ঝুলন্ত হ্যান্ডেলগুলো দেখছেন; সেরকম। প্রতি রবিবার সকাল আটটা সতেরো হলেই দু বালতি জলে স্নান সেরে অফিসের ব্যাগ হাতে সোজা চলে যাই চিলেকোঠার ঘরে আর তারপর হ্যান্ডেল ধরে আধ-ঘণ্টা বেধড়ক ঘুম। ব্যাস, রবিবারে নেমে আসে অপরূপ প্রশান্তি"

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু