Skip to main content

চাংবুমজার মোড়ল



- তা'হলে এই তোমাদের ধর্ম, মোড়ল?

- আমরা তো তোমাদের থেকে ধর্ম-অধর্ম বুঝব না ইঞ্জিনিয়ার সাহেব৷ বারবার তোমাদের বলা হয়েছে, এ গাঁ পর্যন্ত পুল বানাতে পারবে না তোমরা৷ নিয়মিত তোমাদের নেতা-আমলা সক্কলকে বারণ করা হয়৷ তা সত্ত্বেও এই বজ্জাতির কী মানে?

- চাংবুমজা গাঁয়ের মানুষের পক্ষে যে'টা মঙ্গল, তা'তে তোমাদের এত আপত্তি কীসের? পাহাড়ের আর পাঁচটা গাঁয়ে ব্রিজ পৌঁছোয়নি? সে'খানে পিচের রাস্তাঘাট তৈরি হয়নি? হাসপাতাল বসেনি? তা'তে মানুষের উপকার হয়েছে৷ তারা সুযোগসুবিধা পেয়েছে, আগের চেয়ে ভালো আছে৷ 

- ব্রিজ৷ রাস্তা৷ স্কুল৷ হাসপাতাল৷ বটেই তো৷ সে'সব গাঁয়ে না আনলে মানুষের মধ্যে শয়তানি, রোগ, আর হাজার রকমের পাপ বয়ে আনবে কী করে! শোনো ইঞ্জিনয়ার, দেওতার আশীর্বাদে আমাদের গাঁয়ের আশি বছরের বুড়োরাও দিনরাত মেহেনত করে, আমাদের কাচ্চাবাচ্চারা সৎপথে আনন্দে বড় হয়৷ 

- তোমার নাতিই গতবছর দু'দিনের জ্বরে মারা গেল না? একটা হাসপাতাল থাকলে, নিদেনপক্ষে ব্রিজটা থাকলে, শিশুটাকে বাঁচানো যেত৷ স্রেফ নিজের জেদের বশে গোটা গাঁয়ের মানুষের ক্ষতি করছ তুমি মোড়ল। 

- আমার জেদ নয় ইঞ্জিনিয়ার সাহেব৷ দেওতার নিদান৷ ও পুল যেই তৈরি করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে, তারই সর্বনাশ হবে৷ দেওতার রোষ থেকে মুক্তি নেই৷

- দেওতার ওপর তোমার ভরসা নেহাতই কম দেখছি মোড়ল৷ আমার সর্বনাশটা তাঁকেই করতে দিতে পারতে৷ এ'ভাবে তুলে আনাটা নিশ্চয়ই দেবতার নিদান নয়৷ এ'বার আমায় গুমখুন করবে আর মানুষ জানবে দেওতার রোষে আমি নিখোঁজ৷ তাই তো?

- তোমার বয়স অল্প ইঞ্জিনিয়ার সাহব৷ রক্ত গরম৷ ওই গরম রক্তের অপচয় করে লাভ নেই৷ তবে তোমার নিজের দুনিয়ায় ফেরত গিয়েও আর কাজ নেই৷ 

- এর মানেটা কী? আমায় বন্দী করে রাখবে?

- এ গাঁয়ে মোড়লের অনেক কাজ, ইঞ্জিনিয়ার৷ আর ইঞ্জিনিয়াররা বেশ কাজের মানুষ৷

- এ'সব আজেবাজে কথার কী মানে?

- গত দু'আড়াইশো বছর ধরে বহু ইঞ্জিনিয়ার চাংবুমজায় পুল বানানোর কাজ শুরু করতে চেষ্টা করেছে৷ আর, তাদের সবাই গায়েব হয়ে গেছে৷ জানোই তো। দেওতার রোষ।

- সে তো দেখতেই পারছি৷ কী'ভাবে কী ঘটে৷ আর দেওতার রোষের ভাঁওতাটা এ'বার থাক না মোড়ল৷ 

- বেশ৷ তা, যা বলছিলাম৷ একের পর এক ইঞ্জিনিয়ার গায়েব হয়ে যায়৷ তাই বহুদিন এ'সব পুল বানানোর পরিকল্পনা বন্ধ ছিল৷ কিন্তু অদ্ভুতভাবে, এ'তে আমরাও পড়লাম মহাফাঁপড়ে৷ বিশেষ করে আমি।

- তোমার মাথা ঠিক আছে মোড়ল?

- আমাদের গাঁয়ের মানুষ আমায় কেন এত ইজ্জত দেয় জানো? তুকতাক করে সবার পিলে চমকে দিই বলে নয়৷ সে কাজের জন্য পুরুত আছে৷ আমি বানাই যন্ত্রপাতি৷ আমার দলবল আছে, তবে আমিই উপায় বাতলে দি৷ চাংবুমজায় সে'টাই সবচেয়ে বড় যাদু৷ চাষবাষ, ঘরবাঁধা, জল তোলা, আরও কত কী। সে সমস্তর দায়ই আমার৷ কাজেই বুঝতেই পারছ, চাংবুমজার মোড়লপনা চাট্টিখানি কথা নয়৷ ইঞ্জিনিয়ার না হলে উপায় নেই৷

- আমি কিন্তু কিছুই..।

- আজ থেকে বাহান্ন বছর আগে আমিও এসেছিলাম এ'খানে ব্রিজ বানানোর জন্য ইন্সপেকশন করতে৷ তারপর ওই৷ ফেরা হল কই।

- এ'সব কী ব্যাপার মোড়ল?

- চাংবুমজার মোড়লগিরি গত কয়েক শতাব্দী ধরে আউটসোর্সড। ইঞ্জিনিয়াররা তো হাজার বছর ধরে আছে৷ কয়েকশো বছর ধরে তারা এ'খানে ছুটে আসছে; এ গাঁয়ে রাস্তা বা ব্রিজ বানাবে বলে৷ এককালে তারা আসত রাজার হুকুমে, এখন আসে সরকার বাহাদুরের ইচ্ছেয়৷ আমরা কী করি? দরকার মত ধারালো সব ইঞ্জিনিয়ার নেতাদের তুলে আনি চাংবুমজায়৷ তাদের সামনে দু'টো পথ খোলা থাকে৷ হয় খুন৷ নয়ত চাংবুমজার একজন হয়ে থেকে যাওয়া৷ নিজের ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান দিয়ে গাঁয়ের ভালোমন্দ দেখা৷ আর, সময় মত মোড়ল হয়ে ওঠা৷ এই আমার মত। আর বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইলেই মৃত্যু৷ এ গাঁয়ের মানুষের চোখ ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব।  অবশ্য তাঁদের ভালোবাসার বাঁধন বড় গভীর৷ এ'খানে কিছুদিন কাটানোর পর শহুরে ভাঁওতায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে উবে যায় হে ইঞ্জিনিয়ার৷ তুমি দেখো। এ'খানে থাকলে ঠকবে না৷ 

- তুমি ইঞ্জিনিয়ার? মোড়ল?

- সে'সব ইতিহাস এ'খন অদরকারী। গত বাহান্ন বছর ধরে আমার পরিচয় আমি চাংবুমজার মানুষ৷ এ'দের  ভাষা, ভাবভালোবাসা, রীতিনীতি সব আমার ধমনীতে ঢুকে গেছে৷ আমার ঘরসংসার সন্তানসন্ততিও এ'খানেই৷ আর গত তিরিশ বছর ধরে আমি এ'খানকার মোড়ল৷ আমার আগে যে মোড়ল ছিলেন সে ভদ্রলোক এককালে বেলজিয়ান ছিলেন৷ মারা গেছেন অবশ্য চাংবুমজার একজন হয়েই। যেমন আমাকেও যেতে হবে৷  বয়স তো কম হল না। যাক গে৷ এ গেল পুরনো কাসুন্দি৷ আমি খবর নিয়েছি। তুমি ভালো ইঞ্জিনিয়ার৷ সংসার পাতোনি এখনও৷ এ'বার ভেবে বলো৷ এসে গুছিয়ে বসবে আমাদের গাঁয়ে? আমি আর ক'দিন, চাংবুমজার মোড়ল তুমিই হবে তারপর৷ তোমার আমাদের বড় দরকার ইঞ্জিনিয়ার৷ যাবে তো? নাকি, আমায় আজ একটা খুন করতেই হবে?

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু