Tuesday, August 3, 2021

বাটারফ্লাই

ভদ্রলোক আমার হোমিওপ্যাথির চেম্বারে এসে বসতেই খটকা লেগেছিল৷ নাকের নীচে অমন বাটারফ্লাই গোঁফ এমনিতেই এ যুগে বেমানান৷ তার ওপর বিজ্ঞাপনে দেখা ঠিক অবিকল সেই সে'রকম মাথা জোড়া চকচকে টাক, গোলগাল চেহারা, থুতনিতে কাটা দাগ, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা৷ ঠিক যেন থিয়েটারের স্টেজে উঠবেন বলে মেকআপ করে বসে আছেন, এমন চেহারা খবরের কাগজের আবছা ছবিতে একবার দেখেও ভুলে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই৷ এমন কী বিজ্ঞাপনের ছবিতে যে পোশাকে তাকে দেখা গেছে, এখনও তাই পরে রয়েছেন; চেক হাফ শার্ট আর ধুতি - ঠিক যেন পঞ্চাশের দশক থেকে কেউ টাইম মেশিনে উড়ে এ যুগে এসে পড়েছে। 

নিঃসন্দেহে এ ভদ্রলোক সেই ফেরব্বাজই৷ স্থানীয় পুলিশস্টেশন থেকে গত পরশুর আনন্দবাজারে এ লোকটির ছবিসহ বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হয়েছিল যে এই মহৎপ্রাণ নাকি বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন নামে নিজেকে পরিচয় দিয়ে লোকজনকে ঠকিয়ে চলেছেন,  একে দেখলেই যেন থানায় খবর দেওয়া হয়৷ সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো এখনও পর্যন্ত লোকটা কোনও চুরিছিনতাই করেছে বলে খবর নেই৷ তবে ব্যাপারটা অত্যন্ত ফিশি, কোনও বিদেশী গুপ্তচর হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই৷ 

হোমিপ্যাথি করে আজকাল ক'পয়সাই বা জোটে৷ মাস দুয়েক আগে তাই সেক্রেটারিটিকে বিদেয় দিতে হয়েছিল, তার মাস-মাইনে আমার পক্ষে চালানো বেশ মুস্কিল হচ্ছিল। রুগীর ভীড়ও তেমন হয়না আজকাল৷ কাজেই নামধাম লেখানোর দরকারও তেমন থাকেনা৷ দিনে দু'চারজন বড় জোর জোটে, সবাই পুরনো পেশেন্ট৷ কেউ কেউ তো ওষুধ ন্য, স্রেফ আড্ডা বা তাস খেলার লোভে এসে বসেন। তা, হঠাৎ এই ভদ্রলোক টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতেই পিলে চমকে গেছিল, তবে নার্ভাসনেসটা চেপে রাখতে পেরেছিলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই প্ল্যান কষে নিয়েছিলাম,  ওষুধের পুরিয়া আনার বাহানায় পাশের ঘরে গিয়ে মোবাইল থেকে থানায় ফোন করব৷ কিন্তু ভদ্রলোক চেয়ার টেনে বসে প্রথমেই যে কথাটা বললেন তা'তে না ভেবড়ে উপায় ছিলনা৷ 

"আমায় চিনতে পারছিস না পিলু"?

বলে কী! ভাঁওতাবাজির ব্যাপারেও ফ্রন্টফুটে খেলছে। মাথা ঠাণ্ডা রাখলাম। 

"আপনাকে তো আমি চিনি বলে মনে হচ্ছে না", গলা সাফ করে বললাম৷ 

" আমি অনি! অনিন্দ্য হালদার৷ জানি ব্যাপারটা গোলমেলে, কিন্তু ভাই...তুই বিশ্বাস না করলে যে আমায় জলে পড়তে হবে। বাড়িতে বৌ ছেলে পর্যন্ত..."। ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে একট অদ্ভুত ঠাণ্ডা সুর মেশানো রয়েছে যেন। কিন্তু মহাফেরব্বাজ ব্যাটা। অনিন্দ্য হালদার আমার ছেলেবেলার বন্ধু, ক্লাসমেট৷ ছ'ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা, টেনিস খেলা চাবুক চেহারা। ক্লিন শেভেন আর মাথায় দিব্যি ফুরফুরে চুল৷ হাইকোর্টের দাপুটে উকিল। এ ভদ্রলোক অনিন্দ্য হালদার হলে আমি রোনাল্ড রেগ্যান। 


দাঁত চেপে বললাম, "দেখুন আমি হোমিওপ্যাথি করি৷ আপনার যদি কোনও সমস্যা থাকে খুলে বলুন.."। ততক্ষণে আমি সে ঠগবাজের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই মোবাইলে মেসেজ টাইপ করতে আরম্ভ করেছি। দারোগা সমাজপতি আবার আমার হোমিওপ্যাথির ভক্ত৷ ওর হাঁটুর ব্যথায় নাকি আমার পুরিয়া ম্যাজিকের মত কাজ দিয়েছে৷ থানাও আমার চেম্বার থেকে পাঁচশো মিটারের মধ্যেই রয়েছে। আমার এস-এম-এসে সে ছুটে আসবেই। তাছাড়া থানা থেকেই এর খোঁজ চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, কাজেই তাদেরও তাগিদ কম নয়। 

"তোর জায়গায় থাকলে আমিও অবিশ্বাস করতাম। কিন্তু পিলু, আমি বড়ই বিপদে পড়েছি৷ শোন, আমিই অনি৷ অনিন্দ্য! আমরা ছেলেবেলায় ইংলিশ স্যারের সিগারেটের বাক্স থেকে সিগারেট চুরি করেছি৷ তোর প্রেমের চিঠির বানান আমিই ঠিক করে দিয়েছি৷ তোর কাছ থেকে আমি প্রায়ই হজমের ওষুধ নিয়ে থাকি। সান্যালবাড়ির রোব্বারের ব্রিজের আড্ডার তুইই আমার পার্টনার"। প্রতিটা কথা ঠিক, অথচ এ ভদ্রলোক অবশ্যই অনিন্দ্য নয়৷ মহাগোলমেলে লোক৷ পেটে পেটে সাংঘাতিক কোনও মতলব ভাজছে নিশ্চয়ই৷ 

সে তখনও বলে চলেছে, "শোন পিলু, ঠিক এ'রকম চেহারার একজনই আমার সঙ্গেও দেখা করতে এসেছিল গতকাল বিকেলে৷ সে তার পরিচয় দিলে অমিয় বলে। আমিও উড়িয়ে দিয়েছিলাম, ইনফ্যাক্ট ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিই। অথচ..", ভদ্রলোক ফস করে আমার হাত টেনে ধরলেন আকুতি নিয়ে। অমিয় আমার আর অনিন্দ্যর আর এক ক্লাসমেট, এখন প্রমোটারি করে৷ হাজরায় অফিস খুলে জাঁকিয়ে বসেছে৷ কিন্তু তার চেহারাও পেটানো, এ গোলগাল বাটারফ্লাই গোঁফওলার সঙ্গে কোনও মিলই নেই৷ এ'সব বাজে কথা বরদাস্ত করা যায়না৷ 

" আপনি যেই হোন না কেন৷ অনিন্দ্য নন", বলতে বাধ্য হলাম, "আর মিনিট দশেক অপেক্ষা করুন। দারোগাবাবু এসে পড়লেন বলে। তখনই একটা ফয়সালা হবে'খন"। থানাপুলিশের উল্লেখ শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে ভদ্রলোক পত্রপাঠ বিদায় নিলেন৷ আমি অবশ্য তাকে আটকানোর চেষ্টাও করলাম না, হুস করে পকেট থেকে রিভলভার বা ছুরি বের করলেই গেরো৷ সমাজপতি দারোগা এলে বরং আশপাশে খানাতল্লাশি করে দেখবে'খন৷ 

কিন্তু সমাজপতি আসার পর যে খতরনাক ব্যাপারটা ঘটল সে'টা আমি সত্যিই ভাবতে পারিনি৷ সমাজপতি আমায় খুব রগড়ালেন ঝাড়া আধঘণ্টা, " বল্ রাস্কেল! পল্লব ডাক্তারকে তুই কোথায় গুম করে রেখেছিস? বল্"।

যত বলি আমিই পল্লব ডাক্তার, সমাজপতি কিছুতেই সে কথা বুঝতে চায় না৷ আমার নাকের নীচে বাটারফ্লাই গোঁফ যে আচমকা উদয় হয়েছে সে'টা বেশ টের পাচ্ছিলাম, মাথার নতুন গজানো টাকেও ফ্যানের হাওয়া লেগে কেমন শিরশির করছিল। পরনের ফতুয়া আর পাজামা পালটে যে হাফশার্ট আর ধুতি হয়ে গেছে সে'টাও দিব্যি বুঝতে পাচ্ছিলাম।  বুঝলাম এ নিয়ে বাক্যব্যয় করে লাভ নেই৷ সারেন্ডার করলাম৷ 

ইন্সপেক্টর সমাজপতি আমায় প্রায় টেনেহিঁচড়ে নিজের জীপের কাছে নিয়ে গেলেন, তাঁর মুখে তখনও একই বুলি, "পল্লব ডাক্তারের যদি কোনও ক্ষতি হয়...জানবি তোর একটা হাড়ও আস্ত থাকবে না"। 

জীপের স্টিয়ারিং ধরে বসেছিল সমাজপতির চ্যালা হাবিলদার সুখদেও প্রসাদ৷ সুখদেও আমাদের দু'জনকে দেখে একটা বেদম বিষম খেলো। তারপর "জুড়ওয়া ক্রিমিনাল জুড়ওয়া ক্রিমিনাল" বলে দু'চারবার বিশ্রী হাঁক পেড়ে জীপ থেকে লাফিয়ে নেমে হাওয়া হয়ে গেল। 

No comments: