Skip to main content

ওয়ার্নবাবুর বই


ফিল নাইটের ব্যাপারে আগে তেমন কিছু জানতাম না, যতটুকু জেনেছি ও চিনেছি; সে'টা ভদ্রলোকের চমৎকার আত্মজীবনীটা পড়ে। সে তুলনায় শেন ওয়ার্ন স্বাভাবিক ভাবেই বেশ কিছুটা পরিচিত। এবং পরিচিত বলেই তেমন কেউ রেকমেন্ড না করলেও বইটা পড়ে ফেলার আগে বেশি ভাবতে হয়নি। ফিল নাইটের আত্মজীবনী খুব ভালো লেগেছিল কারণ নাইট নিজের কথা বলতে গিয়ে ফোকাস করেছেন তাঁর চারপাশের মানুষের ওপর; সে'সব মানুষের চরিত্র যত ফুটে উঠেছে, পাঠকের কাছে তত স্পষ্ট হয়েছে নাইটের জীবন। এ'দিকে ওয়ার্নের বায়োগ্রাফি জুড়ে ওয়ার্ন দ্য রকস্টার, ওয়ার্ন দ্য ফাইটার, ওয়ার্ন দ্য ট্র্যাজিক হিরো এবং সর্বোপরি ওয়ার্ন দ্য অজি। ওয়ার্নের ক্রিকেট জীবনের অন্যতম গোলমেলে অধ্যায় বুকির থেকে টাকা নেওয়ার ঘটনাটা। সে সম্বন্ধে ওয়ার্ন বেশ কিছু স্পষ্ট ইনফরমেশন দিয়েছেন বটে কিন্তু নিজের পক্ষে যে যুক্তিগুলো সাজিয়েছেন তা আমার অন্তত বেশ কাঁচা মনে হয়েছে। আর বই জুড়ে মাঝেমধ্যেই উঁকি মেরেছে তাঁর ধারালো নাক উঁচু মেজাজ; বিশেষত ড্যারিল কালিনান প্রসঙ্গে (অপ্রাসঙ্গিক ভাবেও তাঁকে কম খোঁচা মারেননি ওয়ার্ন)।

তবুও, এই বই আমি এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করেছি এবং সবচেয়ে বড় কথা; স্বীকার করে নিয়েছি যে সাদায় কালোয় শেন ওয়ার্নদের বিচার করা মুশকিল। ভদ্রলোকের ঘ্যামকে কুর্নিশ না করে থাকা যায় না; খানিকটা ভক্তই হয়ে গেলাম বোধ হয়। এ বইকে 'মাস্ট রীড' (আমার মনে হয়েছে) কেন?

১। স্পিন বোলিংয়ের শিল্প নিয়ে ওয়ার্ন কথা বলতে শুরু করলে মনে হয় দুনিয়ার বাকি সব কিছু মুছে যাক; শুধু এ'টুকুই টিকে থাকুক। যে প্যাশন আর কঠোর মনঃসংযোগের গল্প শেন এ বইতে শুনিয়েছেন তা'তে চমৎকৃত হতেই হবে। উনি যখন স্পিন বোলিংয়ের টেকনিক নিয়ে আলোচনা করেছেন; আঙুল এবং হাতের তালুর পজিশনের কথা বলেছেন বা নিজের রান-আপ বিশ্লেষণ করেছেন; তখন ক্রিকেট-গবেট হয়েও আমার মনে হয়েছে হাতের কাছে একটা ক্রিকেট বল থাকলে একটু ফ্লাইট দেওয়ার চেষ্টাচরিত্র করে দেখা যেত। তাঁর স্পিন-কাহিনীকে অন্য স্তরে নিয়ে গিয়ে আলোচনা করেছেন ওয়ার্ন যখন তিনি স্পিন বোলিংয়ের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। লালমোহন হলে স্বীকার করতেন; "থ্রিলিং ব্যাপার মশাই"। স্পিন বোলিং স্রেফ প্রতি বলে উইকেট পাওয়ার মরিয়া চেষ্টা নয়, বিভিন্নভাবে একজন ব্যাটসম্যানকে প্রস্তুত করতে হয়, এবং তারপর নিকেশ করতে হয় মোক্ষম চালে। বেয়নেটে ফালাফালা করে দেওয়ার গল্প স্পিন নয়, বরং নাকে নাক ঠেকিয়ে আদর করতে করতে একটা ধারালো ছুরি এমনভাবে গলায় ছুঁইয়ে দিতে হবে যেন কেউ গলায় পালক বুলিয়ে দিল; আর অমনি ঝরে পড়বে তাজা গরম রক্ত।

২। ইংলিশ ক্রিকেট কালচার। লক্ষ্মণের আত্মজীবনীতেও প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছে সাহেবদের নিখাদ ক্রিকেট ভালোবাসার কথা আর সে ভালোবাসা থেকে তাঁদের ঘরোয়া ক্রিকেটও বঞ্চিত নয়। লক্ষ্মণের মতই তরুণ শেনও ক্রিকেটের গভীরে প্রবেশ করেন ইংল্যান্ডেই। আর অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ানদের খেলাধুলোর প্রতি ভালোবাসা, তাঁদের অধ্যবসায়। অজিরা একবগগা, ব্রিটিশরা নাকউঁচু; এ'সব জেনারালাইজেশনের মধ্যে যুক্তি খুঁজে লাভ নেই, তবে তাঁদের ক্রীড়া সংস্কৃতির সামনে আমাদের মাথা নুইয়ে দাঁড়াতেই হবে।  খেলা সাহেবদের কাছে ছেলেখেলার ব্যাপার নয়; ওয়ার্নের বইতে সেই কালচারের বিভিন্ন ভাবে আলোচিত হয়েছে। 

৩। বিভিন্ন ম্যাচ সিচুয়েশন ওয়ার্ন যে'ভাবে বর্ণনা করেছেন তা লাজওয়াব। এ ক্ষেত্রে অনেকটা প্রশংসা প্রাপ্য আমার প্রিয় ধারাভাষ্যকার মার্ক নিকোলাসের যিনি ওয়ার্নের হয়ে এই বই লিখেছেন। তবে এই বই যে মার্ক নিকোলাসের ভাষার খেল নয়, আগাগোড়াই ওয়ার্নের; তা স্পষ্ট। গ্যাটিং  বল থেকে সাতশো নম্বর উইকেট; শেনের পিওভি থেকে স্পষ্ট দেখা যায় পিচের রঙ, অনুভব করা যায় ঘাম, উত্তেজনা আর কপালে উড়ে আসা চুল।

৪। ওয়ার্নের ক্রিকেট মস্তিষ্ক আর তাঁর যাবতীয় মাইন্ড-গেম; স্রেফ এ'টুকু নিয়েই একটা নেটফ্লিক্স সিরিজ হতে পারে বোধ হয়। "দ্য বেস্ট ক্যাপ্টেন দ্যাট অস্ট্রেলিয়া নেভার হ্যাড"। সেই ক্যাপ্টেনকে একটানা বেশ কিছু বছর পেয়েছিল হ্যাম্পশায়ার আর কিছুদিনের জন্য রাজস্থান রয়্যালস। ক্যাপ্টেন ওয়ার্ন বলেছেন টীম তৈরির গল্প, বিপক্ষের মাথার মধ্যে ঢুকে সিঁদ কাটার গল্প। টোটকা দিয়ে বুঝিয়েছেন কেভিন পিটারসনের মত ম্যাভেরিককে বা ব্র্যাডম্যান-কাইফকে (হেহ্‌) কী ভাবে সামলাতে হবে। অধিনায়কত্ব প্রসঙ্গে বলা দরকার; সৌরভ সম্বন্ধে ওয়ার্ন যা বলেছেন তা দাদা-ভক্তদের যে 'থ্রিলিং' লাগবেই সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত।

৫। অস্ট্রেলিয়ান টীমের গালগল্প আর টানাপোড়েনের কথা যে'ভাবে বলা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে 'গ্রিপিং'। ওয়ার্ন বেশ চাঁচাছোলা ভাবে সব কিছু বলে যেতে পারেন,কাজেই স্টিভ, বুকানন বা গিলক্রিস্টের সঙ্গে তাঁর মনমালিন্যের গল্পগুলো বেশ 'ছাল ছাড়ানো নুন মাখানো' লেভেলের। বিশেষত বুকাননের সঙ্গে তাঁর গুঁতোগুঁতির ঘটনাগুলো ওয়ার্ন যে'ভাবে বলেছেন তা অত্যন্ত উপভোগ্য (বুকাননের কর্পোরেট ট্রেনিং মডিউলগুলো ওয়ার্ন যে'ভাবে ছারখার করতেন, তা খানিকটা কমিকও বটে)। স্টিভ ও'র  সঙ্গে ওয়ার্নের মতানৈক্য সোজাসুজি দুই ধরণের জীবনধারার সংঘাত। ওয়ার্ন টিম অস্ট্রেলিয়ার প্রতি যে অনুগত ছিলে তা নিয়ে সন্দেহের বিশেষ কারণ নেই কিন্তু স্টিভ-গিলিদের ব্যাগি-গ্রিন স্তুতি বা 'ডিফাইনড স্কোপ অফ প্যাট্রিওটিজম' কে পাত্তা দেওয়ার বান্দা ওয়ার্ন ছিলেন না। আর পাত্তা দিলে তিনি আর যাই হোক ওয়ার্ন হতে পারতেন না। ইয়ে, খেলার বাইরে গিয়ে শচীন সম্বন্ধেও দু'চারটে কটু কথা শেনদাদাকে বলতে হয়েছে; কী এবং কেন সে'টা বললে স্পয়লার দেওয়ার হয়ে যাবে।

৬। জিনিয়াস হয়ে ওঠার 'প্রসেস' আর ট্র্যাজিক পরিণতিগুলো নিয়ে বেশ খোলতাই ভাবে কথা বলেছেন ওয়ার্ন। এই গোটা বইয়ে ওয়ার্নের সুর ভীষণ সোজাসাপটা। কিছুক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে ডিফেন্স  করেছেন বটে, তবে বইয়ের ফ্লো নষ্ট হয়নি তা'তে। ওয়ার্ন যে ওয়ার্ন হয়েই ফুটে উঠেছেন; সে'টাই এই বইয়ের সার্থকতা।

এই হাফ-ডজন কারণে ভর দিয়েই আবারও বলব; আমার এ বই পড়ে মনে হয়েছে "বাহ্‌, দুর্দান্ত"।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু