Thursday, May 17, 2018

অনেকদিন পর

- এই যে বাহাত্তর নম্বর। তোমার রুটের। চলে এসেছে।

- পরের বাসটা নিই?

- সে কী। এই যে বলছিলে তাড়া আছে?

- আছেই তো। তবু। পরেরটা নেব। কেমন?

- আমি বেকার মানুষ। তুমি যদি বলো রাতভর এই বাসস্ট্যান্ডে পড়ে থাকতে, তাও পারব। তোমারই তাড়া। গোটা দিন অফিসের তাড়া। সন্ধের পর বাড়ি ফেরার তাড়া। ফিরে সংসারের কাজকর্মের হুড়মুড়।

- হিংসে করছ অভিরূপ?

- খানিকটা। ভালোই করেছ বাসটা ছেড়ে দিয়ে। বাদুড়ঝোলা অবস্থা।

- পরেরটাও একই রকম থাকবে।

- তা’হলে পরের বাসটা নিও।

- ওমা না। তাহলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। বুবুনের কাল উইকলি টেস্ট। আমার কাছে ছাড়া সে রিভাইজ করতে বসবে না।

- বুবুন। কোন ক্লাসে উঠল?

- সিক্স।

- বড় হয় গেছে। শেষ যখন দেখেছিলাম তখন সে কোলের শিশু।

- তোমার মনে আছে? সূর্য সেন স্ট্রিট? বীণা রেস্টুরেন্ট?

- বিলকুল। কত বছর কেটে গেছে। তুমি আগের চেয়েও রোগা হয়ে গেছ মিতুল।

- সে’টা তো কমপ্লিমেন্ট।

- যাক।

- তুমি কিন্তু বললে না। কী করছ আজকাল।

- বাহ্‌। বললাম যে। সুইট নাথিং। একা মানুষ। ব্যাঙ্কে বাবার রেখে যাওয়া দু’চার পয়সা যদ্দিন আছে খাওয়াপরাটা চলে যাচ্ছে। শেষ হলে ভাবা যাবে’খন।

- ও তোমার এড়িয়ে যাওয়া কথা।

- তুমি বুঝি আমায় খুব কর্মঠ ভাবতে? চিরকাল?

- তা নয়। তবে দিনের পর দিন হাত পা গুটিয়ে কাটিয়ে দেওয়ার লোক তুমি নও অভিরূপ। আর তোমার ইন্টেলেক্ট নিয়ে...।

- ওয়েস্ট। পুরোটাই।

- প্রেম করছিলে না? কী যেন নাম...ঈশানী...।

- আমার প্রাক্তন প্রেমিকার নাম মনে রেখেছ?

- তোমার প্রাক্তন প্রেমিকার নাম। তোমার প্রিয় স্যান্ডুইচ। হেমন্তবাবুর কোন গান শুনলে তোমার গায়ে কাঁটা দেয়। ভোরে ওঠার জন্য তোমার ক'টা ব্যাকআপ অ্যালার্ম দরকার হয়। তোমার লন্ড্রি শিডিউল..।

- থাক থাক, ফর্দ বানিয়ে কাজ নেই।

- অভিরূপ।

- কিছু বলবে?

- কেউ আসেনি? আমার পর?

- নাহ্, এই বেশ আছি।  একা, নিশ্চিন্দি।

পরের বাহাত্তর নম্বর বাস এলো আর মিনিট দশেকের মাথায়। তখন আকাশে সন্ধের লাল ছোপ। বাসে উঠে মিতুল একবার ঘুরে তাকিয়েছিল। অভিরূপের মন খারাপে মিশে গেছিল কলকাতার ধুলো বালি শব্দ সন্ধে। মিনিবাসের সাইলেন্সারের ধোঁয়া ছাপিয়ে বুকে জুঁইয়ের সুবাস অনুভব করেছিল অভিরূপ;  মিতুলের হাসি আজও একই রকম।

মিতুল বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখা। বেশ কিছু বছর আগে সূর্য সেন স্ট্রিটে, আর আজ এই। এই বেশ ভালো। মিতুল একটা গোছানো সংসার পেয়েছে। তার মত বাউণ্ডুলের ঘরের কোণে পচতে হচ্ছে না। বাসে ওঠার মুখে মিতুলের চোখে কি সামান্য চিকচিক দেখা গেছিল?

নিজের পাগলামিতে নিজেই হেসে ওঠে অভিরূপ। সামান্য ক'টা টাকার জন্য মিতুলকে ওএলএক্সে বিক্রি করে দেওয়ার ব্যাপারটা আজও বুকে বাজে ঠিকই, কিন্তু এটাই ভালো হয়েছে। মিতুল অকেজো হয়ে তার নাকতলার ফ্ল্যাটে পড়ে না থেকে একটা সংসারের হয়ে চাকরী করছে, তাদের ছেলে মানুষ করছে; একজন পরিপূর্ণ হোম-অ্যাসিস্ট্যান্ট রোবট হয়ে উঠেছে।

No comments: