Skip to main content

মনোজবাবু ও দিদি

"অ্যাই ভাই, ওঠ"! 

মনোজবাবুর দুপুরের ঘুম ভাঙল দিদি মিতুলের ধাক্কায়। জ্ঞান ফিরলও বলা যায়। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে নিশ্চিন্ত হলে ভদ্রলোক। বছর তিরিশেক সময় সত্যিই পিছিয়ে দিতে পেরেছেন সাধুবাবা। টাকের বদলে মাথার ভর্তি কোঁকড়ানো চুল, কাঁচাপাকা গোঁফের বদলে গোঁফের আলতো রেখা, ক্লাস এইটে যেমনটা তাঁর ছিল আর কী। 

এ'টা তাঁদের ব্যারাকপুরের সেই পুরনো বাড়িটার দোতলার ঘর। সবুজ রঙের দেওয়াল, দক্ষিণের জানালা। মহিন্দর অমরনাথ আর দিলীপ ভেংসরকারের দেওয়াল জোড়া পোস্টার বিছানার মাথার দিকে। সেই ঘর। 

আর দিদি। মনোজবাবুর চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। ঘর আলো করে থাকা দিদি। অঙ্ক শেখানো দিদি। ইংরেজির এস্যে লিখে দেওয়া দিদি। গরমের দুপুরে নুন লঙ্কা দিয়ে মাখা কাঁচা আম খাওয়ানো দিদি। 
দিদির জন্যেই তো এত কাঠখড় পুড়িয়ে ফেরত আসা। হৃষীকেশের সাধুবাবার এই অসাধ্য সাধন করতে পেরেছেন, সে'টা ভাবলেই মনোজবাবুর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। চুয়াল্লিশ বছর বয়স থেকে সোজা চোদ্দয় নামিয়ে দিয়েছেন বাবাজী। অথচ সে সাধুবাবা প্রথমে কিছুতেই রাজী হচ্ছিলেন না। মাস ছয়েক হত্যে দিয়ে পড়ে থাকার পর অবশেষে ওঁর মনে গলেছিল। প্রথম দিকে খালি এক কথা "ইসমে কিসি কি ভলাই নহি বেটা, ওয়াপস মত যা। মত যা"। 

বাবাজীর কাছে খুঁজেপেতে আসতে কম হ্যাপা পোহাতে হয়নি। সাধু তান্ত্রিকের পিছন পিছন ঘুরঘুর করার অভ্যাসটা মনোজবাবুর বহুদিনের, তবে এই বিশেষ বাবাটির দেখা পেতে তাঁকে বিস্তর খাটনি করতে হয়েছে। এই বাবাজীর বাজারে নরবলি দেওয়ার দুর্নাম ছে, কাজেই এর কাছে বড় একটা কেউ ঘেঁসে না। কিন্তু এই সাধুবাবা যে কাউকে সময়ের এ'দিক থেকে ও'দিকে বা ও'দিক থেকে এ'দিকে পাঠিয়ে দিতে পারেন, সে'টা শুনে থেকেই ছটফট করছিলেন মনোজবাবু। তাই  অনেক কষ্টে জঙ্গলে চষে ফেলে এ'কে খুঁজে বের করেছিলেন। ওঁর নিজের অবশ্য সাধুবাবাটিকে দেখে আদৌ খুনে বলে মনে হয়নি। দিব্যি তাঁর জংলি আস্তানার আশ্রয়ে ছ'টি মাস কাটিয়ে দিয়েছিলেন মনোজবাবু। একবার সাধুবাবাজীকে বোকার মত নরবলির ব্যাপারটাও জিজ্ঞেসও করে ফেলেছিলেন, শুনে বাবাজী নিজের ফোকলা দাঁত উজাড় করে টানা পনেরো মিনিট হেসেছিলেন। তবে বয়সের নদীতে পিছিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ তুললেই এড়িয়ে যেতেন সাধুবাবা। অবশেষে যে তাঁকে রাজী করাতে পেরেছিলেন মনোজবাবু, সে'টাই তাঁর পরম ভাগ্য বলতে হবে। 

আজ তাই লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল মনোজবাবুর! কিন্তু দিদি পাগল ভাববে।  এদ্দিন পর দিদিকে দেখে যে কী ভালো লাগছিল মনোজবাবুর। দিদির জন্যেই তো ফেরত আসা। দিদির জন্যেই তো এত কিছু। 

দিদি মারা যায় ঠিক এ'রকমই একটা দিনে। পাড়ার শীতলা পুজোর মেলায় নাগরদোলায় চেপেছিল দিদি, মনোজবাবুর নাছোড়বান্দা হয়ে দিদিকে বাধ্য করেছিলেন তাঁর সঙ্গে নাগরদোলায় চাপতে। 
"চ' না দিদি, চ' না! একবারটির জন্য, দু'জনে মিলে চড়লে কী মজা হবে"। দিদি কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না, ওর নাগরদোলায় বড় ভয়। তারপর যখন মনোজবাবু মুখগোমড়া করে মেলা ছেড়ে বাড়িমুখো হাঁটা দেবেন বলে এগোলেন তখনই দিদি হাত টেনে ধরেছিল। দিদির মন বড় নরম ছিল। সবাই দিদিকে ভালোবাসতো। খুব। মনোজবাবুও ভালোবাসতেন, খুউব। খুউব। কপাল এমন, সে'দিনই নাগরদোলাটার কলকব্জায় গণ্ডগোল ছিল, মনোজবাবু আর দিদি যে সীটে বসেছিলেন, সে'টা মাঝপথে খুলে পড়ে। অনেক উঁচু থেকে ছিটকে পড়েন ওঁরা দু'জন। মনোজবাবু হাত পা দুইই ভেঙ্গেছিল, হাত ঠিক হলেও বাঁ পা'টা পুরোপুরি সারেনি। চিরকাল তাঁকে খুড়িয়েই হাঁটতে হয়েছে। তবে দিদি আর বাঁচেনি। দিদিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ারও সময় ছিল না। আর তারপর থেকেই সব কিছু কেমন পালটে গেল। মা পাথর হয়ে গেলেন, বাবা দিদির মৃত্যুর বছর তিনেকের মাথায় মারা যান কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে। সংসারটা প্রায় ভেসে যায়।  কিন্তু এ'বার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে সমস্ত পালটে দেওয়ার। এ সুযোগ মনোজবাবু কিছুতেই হাতছাড়া করবেন না। 

কথামত ঠিক সেই দিনটায় ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন সাধুবাবা। দিদি ফের ডাকলে, "মেলায় যাবি না ভাই"? 
মনোজবাবু আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছিলেন। দিদির নরম হাত তাঁর মাথায়। দিদির গায়ের সেই মা মা গন্ধ। দিদির নীল রঙের সালোয়ার কামিজে হলুদ রঙের ফুল। জোড়া বিনুনি। দিদির চোখ দু'টো অবিকল মায়ের মত। দিদিকে না জড়িয়ে থাকতয়ে পারলেন না মনোজবাবু। 

"হঠাৎ এত আদর কেন ভাই? আমায় নাগরদোলায় চড়ানোর তাল করছিস? সে গুড়ে বালি, বলে রাখলাম"। দিদির গলায় মিছরিগোলা জল মেশানো। কী ভালোই যে লাগছিল মনোজবাবুর। 

"আমরা নাগরদোলা চাপবই না" ফিসফিস করে বলেছিলেন মনোজবাবু।
"নাগোরদোলা চাপবি না? তোর শরীর খারাপ হল নাকি রে ভাই"? দিদি তো হেসে কুটোপুটি। 

মনোজবাবু মেলায় যাবে না বলে গোঁ ধরে বসেছিলেন, কিন্তু দিদির উপরোধে বেরোতেই হল। 

** 

মেলায় গড়বড় হল কটকটি ভাজা কিনতে গিয়ে। মনোজবাবু স্পষ্ট ঠাহর করতে পারলেন, যে কটকটি বিক্রি যে করছে সে ব্যাটা খোদ সাধুবাবাজী। সাধুবাবা কটকটির ঠোঙা মনোজবাবুর হাতে দেওয়ার সময় স্পষ্ট বললেন
"কুছ বদলনে কা কোশিশ মত কর বেটা, নহি তো খুদ মরে গা। কিসি কো আজ মরনা হি হোগা"। কী অদ্ভুত, দিদি ওঁর এই কথাটা শুনতেই পেলো না। কিন্তু মনোজবাবু বেশ ঘাবড়ে গেলেন। দিদির হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলেন মনোজবাবু। 

বন্দুকবেলুনওলার কাছেও সাধুবাবাজী, "ঝুলে পে চড় বেটা! ঝুলে পে চড়! নহি তো কয়ামত হোগা"। 

নাগরদোলার টিকিটের লম্বা লাইন। অনেক কষ্টে সে'টাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় লাইনে দাঁড়ানো একটা খোকার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন চোদ্দ বছর বয়সে ফেরত যাওয়া মনোজবাবু। টিকিটের লাইনে যে পাঁচবছরের খোকা একা দাঁড়িয়ে সে মনোজবাবুর ছেলে তপু। 
তপু কী করে এলো এ'খানে? তবে কি দিদির বদলে...?
শিউরে উঠলেন মনোজবাবু!। তপু! তপুর কিছু হলে তিনি পাগল হয়ে যাবেন! যদিও তপুর তো সে সময় থাকারই কথা নয়। কিন্তু তবু ও আছে। স্পষ্ট, ওই তপু। আর টিকিট কাউন্টারে যে লোকটা টিকিট দিচ্ছে, ঝকমকে কুর্তাতেও তাঁর আদত চেহারাটা লুকিয়ে নেই; সাধুবাবা! সাধুবাবার মুখে বুক ঠাণ্ডা করা হাসি। ওঁর ঠোঁট নড়া দেখে দূর থেকেই স্পষ্ট ঠাহর করতে পারলেন মনোজবাবু যে উনি বলে চলেছেন; "কুছ বদলনে কি কোশিশ মত কর বেটা, নহি তো কয়ামত হোগা"। 

"চ' না দিদি, চ' না! একবারটির জন্য, দু'জনে মিলে চড়লে কী মজা হবে" এ'বারে গোঁ ধরলেন মনোজবাবু। দিদি অবাক। কিন্তু গোঁয়ের জোরে দিদির রাজী না হয় উপায় ছিল না। টিকিটের লাইনে গিয়ে দাঁড়াতেই মনোজবাবু খেয়াল করলেন যে তপুকে আর দেখা যাচ্ছে না। 
হাঁফ ছাড়লেন তিনি। 

এক টাকা নিয়ে দু'টো টিকিট দেওয়ার সময় টিকিটওলার মুখ থেকে স্পষ্ট শুনতে পেলেন মনোজবাবু;
"বলি চড়তি হ্যায় বেটা, জরুর চড়তি হ্যায়। অউর বলি কো কভি রোকনে কি কোশিশ মত করনা "। 

Comments

Kasturi Bhattacharya said…
অসাধারণ

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু