Skip to main content

অমল তালুকদারের ভাবনা

অমল তালুকদার ভাবছিলেন। তাঁর ভাবতে ভালো লাগে। ভাবার মত ভালো ব্যাপার আর হয় না। এই কিছুক্ষণ আগেই ভাবছিলেন গলে পড়া নরম মোমে আলপিন ঠুসে দেওয়ার কথা। বেশ লাগছিল। তারপর চট করে একটু ঘাসের ডগা নাকে দিয়ে হাঁচি টেনে বের করার কথা ভেবে মাথা নাড়লেন। এরপর অল্প কিছুক্ষণ পোলাও আর আজহারউদ্দীনের কব্জি মোচড় ভেবে মৌজ করলেন। এরপর একটু আয়েসে গা এলিয়ে দেবেন,  এমন সময় একটা তাঁতের আঁচলের ঝাপটা মুখে লেগে ভাবনার সুতোটা গেল ছিঁড়ে।

আঁচলের রঙটা আজ আকাশী ছিল। তা'তে ছোট ছোট কালো ফুল।
ধুস।

- অমল তালুকদার।
- রিয়েলি রিতা? তুমি ওর একটা নামও দিয়েছ?
- বার বার কল্পনার মানুষ হিসেবে অ্যাড্রেস করাটা সবিশেষ সুবিধেজনক নয় ডাক্তার।
- উম। আই সী। ডাস হি হেল্প?
- অবশ্যই।
- সে কথা বলে? তোমার সঙ্গে?
- কথা? না। তার কথা বলার সময় কোথায়? সে অনবরত ভেবে চলেছে। আমি ওর ভাবনাগুলো দেখতে পাই। বড় ভালো লাগে।
- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না রিতা।
- প্রথম প্রথম আমিও বুঝতে পারতাম না। তবে এখন বোঝার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছি। ওর ভাবনাগুলো আমায় ভালো রাখে। যন্ত্রণা কমায়।
- ভাবনাগুলো তোমার রিতা।
- না। বিশ্বাস করো ডাক্তার! ভাবনাগুলো আমার নয়। আমার ভাবনায় অতটা আলো নেই।
- আমার থেরাপির চেয়ে অমল তালুকদারের থেরাপিতেই তোমার বেশি কাজ হয় বলো।
- হেহ্। আমি একটু ভালো থাকতে চাই ডাক্তার। তুমি তো জানো, আমার সময় বড় কম। নিজের ভাবনাগুলো বড্ড জট পাকিয়ে গেছে। ওর ভাবনাগুলো আমার দরকারি, ওগুলো আমায় ভালো রাখে।

"পাঁচ নম্বরে মনোময় মাইতি, মনোময় মাইতি! আছেন? মনোময় মাইতি আছেন"?

রিসেপশনিস্টের ডাকে ধরফড়িয়ে উঠতে হলো। চিন্তার সুতোটা ফের ছিঁড়ল। ধুস। তবে এ'বার আঁচলের ঝাপটায় নয়। কিন্তু মনোময়বাবুর বুক কাঁপিয়ে থেরাপিস্টের চেম্বারের দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলেন তাঁর আকাশী আঁচলে কালো কল্কেফুল।

"চার নম্বর বেরোলেন। এরপর আপনি, আপনিই মনোময় মাইতি তো? ভিতরে যান"।

- ভাবনাকে কেউ পিছু করছে?
- হ্যাঁ ডাক্তার। অনবরত। গত মাস দুই ধরে হচ্ছে। কত ভালো ভালো ব্যাপারস্যাপার ভেবে দিন কাটাই, কিন্তু তা'তে এসে গোল পাকাচ্ছেন ইনি।
- ইনি কে?
- জানি না তো। মহিলা। তাঁতের শাড়ি। ঠিক দেখতে পাইনা। তবে আঁচলের ঝাপটা টের পাই মাঝেমাঝেই। আর সেই আঁচলে ভাবনা গুলিয়ে যায়।  ভাবনা গুলিয়ে যাওয়াটা বড্ড গোলমেলে ডাক্তারবাবু। এই ভাবনাগুলো আমায় ভালো রাখে। সুস্থ রাখে।
- কেমন ভাবনা?
- ছুঁচের মাথা দিয়ে অবলীলায় সুতোর ডগা এস্পারওস্পার করে চলেছি। সমুদ্রের ঢেউয়ে গোড়ালি ডুবিয়ে আখের সরবত আর মুড়ি চানাচুর খাওয়া হচ্ছে। জ্বরের ঘোরে কানে পান্নালাল আর বুকে ভাঁজ করা সঞ্জীবের বই। এইসব। এই ভাবনাগুলো ছিঁড়ে গেলে বড় মুশকিল ডাক্তারবাবু। আমার সময় বড্ড কম।
- সময় কম কেন?
- সেকেন্ড কেমো আগামী মাসে। অবিশ্যি সিচুয়েশন যা, বিশেষ...।

- রিতা! তাই বলে মন্দিরে বিয়ে? তুমি না নাস্তিক?
- জানি ডাক্তার, ব্যাপারটা অদ্ভুত। আমার দ্যাবাটিও নাস্তিক। তবে বিয়ের অকেশনটা নেহাতই শখের। রেজিস্ট্রি বিয়ের জন্য ডেট পাওয়া অনেক হ্যাপা, আর আমাদের সময় বড় কম। যাই হোক, আগামী শনিবার, তোমায় আসতে হবেই। কালীঘাটে। তোমায় ঘটকবিদেয় না করলে আমাদের ওয়েডলকে গড়বড় রয়ে যাবে।
- ইয়েস ইয়েস। আই ডিসার্ভ দ্যাট।যাক,  কঙ্গ্র‍্যাচুলেশনস। তবে, আগামী শনিবার? সে'দিন তোমার অ্যাডমিশন না?
- হ্যাঁ। থার্ড কেমো। তার আগেই বিয়েটা সেরে নিতে চাইছিলাম দু'জনেই। তাই মন্দিরমুখো হচ্ছি।
- মনোময়ের নম্বরটা দিও। ওকেও কঙ্গ্র‍্যাচুলেট করি। সে ব্যাটার থেকেও আলাদা করে ঘটকালির ফীজ চেয়ে নেব'খন।
- আমি তোমায় এসএমএস করে দিচ্ছি ওর নাম্বারটা। তবে ও'কে আর মনোময় বলে ডেকোনা। গত সপ্তাহেই সে বেচারি কোর্টে গিয়ে নিজের নাম অ্যাফিড্যাভিট করে পালটে এসেছে। এখন সে শ্রীযুক্ত অমল তালুকদার।

***

এক ফালি মেঘ,এক ফোঁটা জল,
রংধনুকের একটি কণায়,
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে..
আমার এমন কাঙালপনা ।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু