Sunday, April 16, 2017

অমল তালুকদারের ভাবনা

অমল তালুকদার ভাবছিলেন। তাঁর ভাবতে ভালো লাগে। ভাবার মত ভালো ব্যাপার আর হয় না। এই কিছুক্ষণ আগেই ভাবছিলেন গলে পড়া নরম মোমে আলপিন ঠুসে দেওয়ার কথা। বেশ লাগছিল। তারপর চট করে একটু ঘাসের ডগা নাকে দিয়ে হাঁচি টেনে বের করার কথা ভেবে মাথা নাড়লেন। এরপর অল্প কিছুক্ষণ পোলাও আর আজহারউদ্দীনের কব্জি মোচড় ভেবে মৌজ করলেন। এরপর একটু আয়েসে গা এলিয়ে দেবেন,  এমন সময় একটা তাঁতের আঁচলের ঝাপটা মুখে লেগে ভাবনার সুতোটা গেল ছিঁড়ে।

আঁচলের রঙটা আজ আকাশী ছিল। তা'তে ছোট ছোট কালো ফুল।
ধুস।

- অমল তালুকদার।
- রিয়েলি রিতা? তুমি ওর একটা নামও দিয়েছ?
- বার বার কল্পনার মানুষ হিসেবে অ্যাড্রেস করাটা সবিশেষ সুবিধেজনক নয় ডাক্তার।
- উম। আই সী। ডাস হি হেল্প?
- অবশ্যই।
- সে কথা বলে? তোমার সঙ্গে?
- কথা? না। তার কথা বলার সময় কোথায়? সে অনবরত ভেবে চলেছে। আমি ওর ভাবনাগুলো দেখতে পাই। বড় ভালো লাগে।
- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না রিতা।
- প্রথম প্রথম আমিও বুঝতে পারতাম না। তবে এখন বোঝার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছি। ওর ভাবনাগুলো আমায় ভালো রাখে। যন্ত্রণা কমায়।
- ভাবনাগুলো তোমার রিতা।
- না। বিশ্বাস করো ডাক্তার! ভাবনাগুলো আমার নয়। আমার ভাবনায় অতটা আলো নেই।
- আমার থেরাপির চেয়ে অমল তালুকদারের থেরাপিতেই তোমার বেশি কাজ হয় বলো।
- হেহ্। আমি একটু ভালো থাকতে চাই ডাক্তার। তুমি তো জানো, আমার সময় বড় কম। নিজের ভাবনাগুলো বড্ড জট পাকিয়ে গেছে। ওর ভাবনাগুলো আমার দরকারি, ওগুলো আমায় ভালো রাখে।

"পাঁচ নম্বরে মনোময় মাইতি, মনোময় মাইতি! আছেন? মনোময় মাইতি আছেন"?

রিসেপশনিস্টের ডাকে ধরফড়িয়ে উঠতে হলো। চিন্তার সুতোটা ফের ছিঁড়ল। ধুস। তবে এ'বার আঁচলের ঝাপটায় নয়। কিন্তু মনোময়বাবুর বুক কাঁপিয়ে থেরাপিস্টের চেম্বারের দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলেন তাঁর আকাশী আঁচলে কালো কল্কেফুল।

"চার নম্বর বেরোলেন। এরপর আপনি, আপনিই মনোময় মাইতি তো? ভিতরে যান"।

- ভাবনাকে কেউ পিছু করছে?
- হ্যাঁ ডাক্তার। অনবরত। গত মাস দুই ধরে হচ্ছে। কত ভালো ভালো ব্যাপারস্যাপার ভেবে দিন কাটাই, কিন্তু তা'তে এসে গোল পাকাচ্ছেন ইনি।
- ইনি কে?
- জানি না তো। মহিলা। তাঁতের শাড়ি। ঠিক দেখতে পাইনা। তবে আঁচলের ঝাপটা টের পাই মাঝেমাঝেই। আর সেই আঁচলে ভাবনা গুলিয়ে যায়।  ভাবনা গুলিয়ে যাওয়াটা বড্ড গোলমেলে ডাক্তারবাবু। এই ভাবনাগুলো আমায় ভালো রাখে। সুস্থ রাখে।
- কেমন ভাবনা?
- ছুঁচের মাথা দিয়ে অবলীলায় সুতোর ডগা এস্পারওস্পার করে চলেছি। সমুদ্রের ঢেউয়ে গোড়ালি ডুবিয়ে আখের সরবত আর মুড়ি চানাচুর খাওয়া হচ্ছে। জ্বরের ঘোরে কানে পান্নালাল আর বুকে ভাঁজ করা সঞ্জীবের বই। এইসব। এই ভাবনাগুলো ছিঁড়ে গেলে বড় মুশকিল ডাক্তারবাবু। আমার সময় বড্ড কম।
- সময় কম কেন?
- সেকেন্ড কেমো আগামী মাসে। অবিশ্যি সিচুয়েশন যা, বিশেষ...।

- রিতা! তাই বলে মন্দিরে বিয়ে? তুমি না নাস্তিক?
- জানি ডাক্তার, ব্যাপারটা অদ্ভুত। আমার দ্যাবাটিও নাস্তিক। তবে বিয়ের অকেশনটা নেহাতই শখের। রেজিস্ট্রি বিয়ের জন্য ডেট পাওয়া অনেক হ্যাপা, আর আমাদের সময় বড় কম। যাই হোক, আগামী শনিবার, তোমায় আসতে হবেই। কালীঘাটে। তোমায় ঘটকবিদেয় না করলে আমাদের ওয়েডলকে গড়বড় রয়ে যাবে।
- ইয়েস ইয়েস। আই ডিসার্ভ দ্যাট।যাক,  কঙ্গ্র‍্যাচুলেশনস। তবে, আগামী শনিবার? সে'দিন তোমার অ্যাডমিশন না?
- হ্যাঁ। থার্ড কেমো। তার আগেই বিয়েটা সেরে নিতে চাইছিলাম দু'জনেই। তাই মন্দিরমুখো হচ্ছি।
- মনোময়ের নম্বরটা দিও। ওকেও কঙ্গ্র‍্যাচুলেট করি। সে ব্যাটার থেকেও আলাদা করে ঘটকালির ফীজ চেয়ে নেব'খন।
- আমি তোমায় এসএমএস করে দিচ্ছি ওর নাম্বারটা। তবে ও'কে আর মনোময় বলে ডেকোনা। গত সপ্তাহেই সে বেচারি কোর্টে গিয়ে নিজের নাম অ্যাফিড্যাভিট করে পালটে এসেছে। এখন সে শ্রীযুক্ত অমল তালুকদার।

***

এক ফালি মেঘ,এক ফোঁটা জল,
রংধনুকের একটি কণায়,
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে..
আমার এমন কাঙালপনা ।

No comments: