Skip to main content

গৌরহরি বস্ত্রালয়


গৌরহরি বস্ত্রালয়দেড়-তলার কাপড়ের দোকান। দোকানের মাথার গ্লো-সাইন আর মালিক মধু মল্লিকের চামড়ায় ভাঁজ ছাড়া, জন্ম হতে আজ তক; দোকানটি কে একই চেহারায় দেখে অভ্যস্তহাজার শপার্স স্টপ এসেও এর হুলিয়া বদলাতে পারেনি বা এর ব্যবসায় চাকু বসাতে পারেনি। নিচের তলা জুড়ে শুধুই শাড়ি, এবং ওপরের হাফ-তলা জুড়ে “জেণ্টস কাম কিডস সেকশন” । ধবধবে গদিতে বসে মধুকাকু কর্মচারীদের ধোনী-ভঙ্গিতে চালনা করছেন এবং চকাম শব্দে মিঠে সুপুরি চিবুচ্ছেন, এ দৃশ্য অতি পরিচিত। দোকান-ময় ধুপ, ঘাম, কাপড় এবং পুরনো দেওয়ালের গন্ধ মেশানো একটা হাওয়া ঘুর-পাক খাচ্ছে সর্বক্ষণ কিন্তু তবুও সাবেকি রুচির ক্রেতাদের ভীড় লেগেই আছে; “বেস্ট কোয়ালিটি এন্ড প্রাইস ইন দ্য টাউন” পিতৃদেবের মতে।

পিতৃদেব বছরে দুইবার কাপড়-জামা কেনেন, পুজো এবং পয়লা বৈশাখ; গুষ্টির সক্কলের জন্যে; এবং জন্মাবধি দেখে আসছি যে প্রত্যেকের জন্যে একি ধরনের পোশাক প্রত্যেক বার। যেমন পয়লা বোশেখে আমার জোটে একটা ফতুয়া, একটা পাঞ্জাবি ও একটি কমন পায়জামা। পুজো এলে জোটে একটা চকমকে হাফ শার্ট, একটা গম্ভীর ফুল শার্ট এবং একটা ট্রাউজার। ক্লাস সিক্স থেকে এই বয়স পর্যন্ত এর অন্যথা হয় নি। এবং গৌরহরি বস্ত্রালয়য়ের মধু মল্লিক পিতৃদেব কে ভারী খাতির করেন; কর্মচারীদের হাতে ছেড়ে দেন না; পিতৃদেব এলে নিজেই এগিয়ে এসে কাপড়-জামা দেখান।

এবং এই আঠাশ বছর বয়সেও মধুবাবু আমায় পচাবাবু বলে ডাকেন এবং প্রত্যেক পুজো মরশুমে আমি শুনতে পারি যে “পচাবাবু কী আরেকটু লম্বা হয়েছো নাকি?”প্রত্যেক বার এইটে বলে আমার পিতৃদেবের সঙ্গে একটু খোলতাই হেসে নেনএরপর তিনি পিতৃদেবকে চা অফার করবেন এবং অত:পর নয়া কাপড়-জমা দেখাতে দেখাতে শুরু করবেনগত বিশ-বাইশ বছরে এই নিয়মের অন্যথা হয়নি

পুজো সামনে, এইবারেও যথারীতি উপস্থিত পিতৃদেবের সঙ্গে গৌরহরি বস্ত্রালয়ে। ইউসুয়াল “পচাবাবু কী আরেকটু লম্বা হয়েছো নাকি?” ঠাট্টা ঝাড়লেও, মল্লিকবাবুর মেজাজ একটু অফ-ফর্মে দেখলাম। পিতৃদেবও সিচুয়েশন জরিপ করে বেশি হ্যা-হ্যা তে গেলেন না। বিস্তর কাপড়-জামা কিনে বেরোবার আগে পিতা যথারীতি মল্লিক-বাবুকে বললেন “ চলি মল্লিকদা, আবার দেখা হবে চৈত্র মাসে”
-“আর হয়তো দেখা হবে না মুখার্জীদা”, অতি-ম্লান হাসি ফুটিয়ে বললেন মধু মল্লিক।
_ “ কেন? দেখা হবে না মানে?”, পিতা দম-অবাক

-“ এ বছর আমার ছেলে-মেয়ে-বউ নিজেদের দোকানের কাপড় না কিনে; কলকাতার শপিং মল ঘুরে পুজো বাজার করে এনেছে। এমনকি গিন্নীও পিঠে ছুরির ডগা ডলে দিয়েছে, ছেলে-বউদের সঙ্গে ভীড়ে কোলকাতার ঠান্ডা দোকান থেকে  থেকে লোচ্চা শাড়ি কিনে এনেছে। চ্যারিটি এণ্ড অনেষ্ট বিজনেস; বিগিনস এট হোম মুখুজ্জেদা, নিজের ফ্যামিলিকেই যখন নিজের প্রোডাক্ট সম্বন্ধে কনভিন্স করতে পারলাম না, পাবলিকের কাছে নিজের পসরা সাজিয়ে বসবার কী অধিকার আছে আমার? দোকান ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দিয়েছি। এ শহরে এসে এই কাপড়ের দোকান দেওয়ার আগে আমার ঠাকুরদা বর্ধমানে গামছা বিক্রি করতেন। আমিও বর্ধমানের পৈত্রিক ভিটেতে শিফ্ট করছি। একাই শিফ্ট করছি; গিন্নীকেও বাদ রেখেছি; লেডি মির্জাফর কী না! বর্ধমানে গিয়ে একটা গামছার শো-রুম খুলবো আমার ঠাকুরদার নামে; গৌরহরি গামছা প্যালেস। সব ঠিক হয়ে গ্যাছে প্রায়।  উইশ মি লাক”

ধরা গলায় পিতৃদেব বললেন, “মল্লিকদা, আপনি তো সোলজার মশাই! কৌন বোলা হ্যায় আমাদের দেখা হবে নাআমি গামছা কিনতে বর্ধমান আসবো, আসবোই”

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু