Monday, August 7, 2023

সৈন্যদল

গোটা ছাউনি জুড়ে গা-কাঁপানো নিস্তব্ধতা। খান কুড়ি জওয়ান আর গোটা সাতেক অফিসার গোল করে দাঁড়িয়ে; সবারই মুখ কালো। 

আর সেই থমথমে বৃত্তের পরিসরেই কর্নেল ডঙ্কা অস্থির হয়ে পায়চারি করছিলেন। থেকে থেকেই   বলে উঠছিলেন, "আসুক ব্যাটাচ্ছেলেরা, সবকটাকে জ্যান্ত কবর দেব"।

একসময় বাধ্য হয়ে সুবেদার গোলদারি মিনমিনিয়ে বলে উঠলেন "জ্যান্ত কবর দেওয়ার ব্যাপারটা তো ওরা না আসলে শুরু করা যাবে না। মানে হাতে সময় যখন আছে একটু চা বসিয়ে দিই না হয়"।

কর্নেল ডঙ্কা পায়চারি থামিয়ে আগুন চোখে তাকালেন গোলদারির দিকে৷ পলাশগাঁ না ঘুরঘুরিয়াপুর; কোথায় যেন একজন তান্ত্রিক চোখের দৃষ্টি দিয়ে চামচ বেঁকিয়ে দিতে পারে; এমন তেজ তাঁর। কর্নেল ডঙ্কা খানিকক্ষণ কনসেনট্রেট করার চেষ্টা করলেন, যদি সুবেদার গোলদারির ঝুলো গোঁফজোড়ায় একটা মারাত্মক টান দেওয়া যায়। সুবিধে করতে না পেরে "ধিত্তিরি" বলে ফের শুরু করলেন পায়চারি।

পরিস্থিতিটা গোলমেলে বুঝে ক্যাপ্টেন গঁট্টা সপাটে একটা ধমক দিলেন সুবেদার গোলদারিকে; "তোমার বুদ্ধির বলিহারি ভাই গোলদারি। কথায় কথায় তোমার শুধু চা আর চা। আরে ইউনিটের সামনে একটা মারাত্মক বিপদ৷ কোথায় কফি আর সামান্য ভাজাভুজির ব্যবস্থা করবে তা না চ্যা চ্যা চ্যা! ছি: ছি:"।

আর সহ্য হল না কর্নেল ডঙ্কার। বেরিয়ে এলো হতাশা মেশানো হুঙ্কার, "কী কুক্ষণেই না একদল  মেনিমুখোকে নিয়ে ফ্রন্টে এসেছিলাম"।

গোলদারি ফস করে বলে বসলেন "এ জন্যেই আমি হাতের কাছে একটা পঞ্জিকা রাখি। দিনক্ষণ এ'দিক ও'দিক হলেই চিত্তির আর কী"। 

কর্নেল ডঙ্কার পায়চারি থামলো।

গোলদারি কর্নেলের চোখ এড়িয়ে ছাউনির ছোট্ট জানালার বাইরে তাকালেন। বাতাস বারুদের গন্ধে ভারি হয়ে আছে, চারপাশটা ভীষণ গুমোট। 

"আর মোটামুটি আধঘণ্টা", খানিকটা শান্ত হয়ে বললেন কর্নেল ডঙ্কা, "তারপরেই মাতামাতিল্যান্ডের এয়ারফোর্স এসে বোমবাজি শুরু করবে"।

ক্যাপ্টেন গঁট্টা গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, "ভাজাভুজির সময় হবে না হে গোলদারি৷ কাজেই সাতপাঁচ না ভেবে কফিই হোক৷ আর ইয়ে, বলছি ভায়া আবশুল, তোমার স্টকে ক্রীম বিস্কুট শুনেছি"?

সুবেদার আবশুলের চিঁচিঁ প্রতিবাদ শোনা গেল, "দু'টিন মাত্র৷ ও'তে সবার হবে না৷ আমিই বরং যতটা পারি একা খেয়ে নেব৷ বম্বিং ব্যাপারটা টিনের বাক্স সার্ভাইভ করতে পারবে না তো। তাই আর কী.."।

"তোমরা বদ্ধ উন্মাদ", এ'বারে চেঁচিয়ে উঠলেন কর্নেল ডঙ্কা। 

গোলদারির মুখ এ'বার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, "আর আপনি আমাদের নেতা"।

হাল ছেড়ে নিজের চেয়ার টেনে নিয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন কর্নেল ডঙ্কা। আড়াই মিনিটের মাথায় মুখের তিতিবিরক্ত ভাবটা কেটে গেল। কর্নেল ডঙ্কা এ'বার খানিকটা মিহি সুরে বললেন, "দ্যাখো, দেশের জন্য তোমরা তো কম করলে না৷ বাহদিব্যিস্তান তোমাদের আত্মত্যাগ ভুলবে না। শেষবারের জন্য বলছি৷ পোজিশন আঁকড়ে আমি আছি। শেষ রিপোর্টিংয়ের ব্যাপারটা আমিই সামলে নিতে পারব৷ এখনও কিছুটা সময় আছে, তোমরা পারলে এ'খান থেকে চলে যাও। প্রাণে বাঁচলেও বাঁচতে পারো"।

ক্যাপ্টেন গঁট্টা এ'বারে গলায় দরদ এনে বললেন, "বুঝলে গোলদারি৷ কর্নেল সাহেবের বোধ হয় চায়ের দিকেই ঝুঁকেছেন৷ বেশ, থাক তা'হলে কফি৷ কফির মর্ম আর ক'জন বুঝবে। চাপাও সসপ্যান। ফরওয়ার্ড মার্চ"।

গোলদারি হাততালি দিয়ে উঠলেন, "এই হলো সাচ্চা বাঘের বাচ্চার মত কথা। আরে আমি আগেই আদা থেঁতো করে রেখেছি। ওই চায়ের কাছে কোথায় লাগে কাঠখোট্টা কফি.."।

একরাশ হতাশা নিয়ে কর্নেল বলে উঠলেন, "পাগল। সবকটা বদ্ধ পাগল"।

ফের শোনা গেল সুবেদার আবশুলের চিঁচিঁ কণ্ঠস্বর,  "চা হোক আর কফিই হোক৷ দু'টিন ক্রিম বিস্কুট কিন্তু আমি একা খাবো বলে দিচ্ছি৷ বউটি নিজের হাতে আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে পইপই করে বলেছিল যাতে ও জিনিস আমি বারোভূতকে খাইয়ে শেষ না করি"।

**

চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে গোলদারির দিকে সম্ভ্রম নিয়ে তাকালেন কর্নেল ডঙ্কা, "তোমার সত্যিই জবাব নেই গোলদারি। এ চা নয়, অমৃত"। গোলদারি ফর্সা দু'গালে সামান্য লালচে ছোপ লাগলো। 

তখুনি, বাইনোকুলারে চোখ রাখা এক জওয়ান মৃদু স্বরে জানালে যে  মাতামাতিল্যান্ড এয়ারফোর্সের কয়েকটা বিমানকে আকাশে চক্কর কাটতে দেখা যাচ্ছে।

ক্যাপ্টেন গঁট্টা চেঁচিয়ে উঠলেন, "এইবারে তা'হলে যে'যার জায়গায় চলে যাওয়া যাক"।

" এক মিনিট", শান্ত সুরে বললেন কর্নেল ডঙ্কা। নিজের প্লেটে পড়ে থাকা শেষ ক্রীমবিস্কুটটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন সুবেদার আবশুলের দিকে। আবশুল আনমনে ছাউনির জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, দু'হাতে আঁকড়ে ধরা দু'টো বিস্কুটের টিন।

"আবসুল", কাঁধে হাত রাখলেন কর্নেল ডঙ্কা। 

"স্যর", সম্বিৎ ফিরে পেল আবসুল। 

" আমি কিন্তু খেয়াল করেছি তুমি একটা বিস্কুটও না খেয়ে সবাইকে বিলিয়ে দিলে"।

"কর্নেল সাহেব, আমার বাড়িতে বুড়ো বাপ-মা, ছোট্ট দুই ছেলে আর বৌ৷ অভাবের সংসারে ভুট্টা আর গমের বাইরে খরচ করার সুযোগ কোথায়? ক্রিমবিস্কুট তো বিলাসিতা। বড় শখআহ্লাদে কেনা কয়েকটা বিস্কুটের টিন, আমায় জোর করে গছিয়ে দিল ফ্রন্টে আসার সময়৷ কত করে বোঝালাম, আরে অত ক্রিমবিস্কুট আমি একা খাবো কী করে৷ বাড়ির বাচ্চাগুলোকে দাও অন্তত৷ বৌ গোঁ ধরলে, বাড়ি থেকে কতদূরে কতদিন থাকব, ও'টুকু নাকি সঙ্গে না নিলেই নয়৷ পুঁচকে ছেলেগুলোও এক সুরে কথা বললে। মায়ের ন্যাওটা তো খুব৷ জানেন, ও বিস্কুট একটাও কেউ মুখে দেয়নি। সে বিস্কুট আমি কী করে খাবো কর্নেল সাহেব"?

আবশুলকে জড়িয়ে ধরলেন ক্যাপ্টেন ডঙ্কা। বোমারু বিমানের তর্জনগর্জনে তখন কান পাতা দায়।

No comments: