Skip to main content

বাটপার

- স্যার, সরি। ভেরি সরি। আর করব না এমনটা! মাইরি বলছি। ভদ্রকালীর দিব্যি...।
- মন্টু, শোনো...শোনো...।
- গড প্রমিস করছি স্যার। এ'বার ছেড়ে দিন। দিব্যি দিয়ে বলছি আমি আর জীবনে পকেট মারব না। আমি এ'পাড়াতেই আর আসব না। এক্কেবারে খোদার কসম স্যার। এইবারটি ছেড়ে দিন মাইরি। আমি বুঝতে পারিনি জাস্ট...। শুধু এ পাড়া কেন, এই ডিসট্রিক্টে যদি ফের আমায় দেখেন তা'হলে সোজা চাক্কু চালিয়ে দেবেন। কিচ্ছুটি বলব না...।
- আহ মন্টু...।
- প্লীজ ছেড়ে দিন স্যার...।
- আমার পা ছাড়ো আগে...।
- কিছুতেই না, মরে গেলেও আপনার পা ছাড়ব না। আমি ভগবান স্যার, আমি ছুঁচো। খামোখা একজন পকেটমারকে সাইড করে নিজের হাত গন্ধ করবেন কেন বলুন। প্লীজ দাদা...থুড়ি...স্যার...। ছেড়ে দিন না...আমি ছাই কী করে বুঝব বলুন, যে সাত জেলা কাঁপানো গুণ্ডা-শ্রেষ্ঠ বিধু হালদার অমনভাবে লোকাল ট্রেনে বসে সল্টেড বাদাম চিবুবে। আর সব দোষ আমার আঙুলের, আপনার ফতুয়ার আলগা পকেট পেয়ে সুট করে আঙুল এগিয়ে গেল মাইরি। তা তখনই আমায় দু'টো থাপ্পড় মেরে দিতে পারতেন তো।
- তোমার ভুল হচ্ছে মন্টু...।
- আচ্ছা বেশ, না হয় একটা ঠ্যাং ভেঙ্গে ছেড়ে দিতেন। আড়াই মাস লেংচে চলতাম। বেশ হত। আমার মত গবেটের লেংচেই চলা উচিৎ। একটা কান কেটে নিলেও আপত্তি করতাম না। কিন্তু স্যার, এই অধমকে তাই বলে এমনভাবে তুলে আনবেন? নিজের ডেরায় এনে লাশ ফেলবেন? জানি ব্যাপারটা আপনার কাছে জলভাত...তবু...বাড়িতে সে আমার এক বিধবা পিসি, দু'টো আধ-পোষা বেড়াল, তিনটে জবা গাছ; সব জলে যাবে।
- আরে ধুরছাই। তোমায় আমি খুন করব বলে তুলে আনিনি। পকেটমারিতে তোমার সত্যিই এলেম আছে। আমি তোমায় তুলে এনেছি একটা বিশেষ কাজে। তা আমার লোকজন তোমায় মারধোর করেনি তো?
- একদমই না। শুধু হাত-পা-মুখ বেঁধে, চ্যাংদোলা করে একটা অ্যাম্বাসাডার গাড়ির ডিকিতে দিন দেড়েক বন্ধ করে রাখলে, তারপর এই আপনার চোরকুঠুরিতে এনে তিন দিন বন্ধ করে রাখলে। সামান্য মানিব্যাগ সরিয়েছিলাম স্যার। ও'তে সাতশো বাহান্নটাকা ছিল। ছেড়ে দিননা স্যার, আমি পিসির গয়না বিক্রি করে সাতহাজার টাকা আপনার অফিসে জমা করে যাব। রসিদও চাইব না; পিসির দিব্যি। বিধবা বুড়ির ও'সবে গয়নাটয়নায় কাজ কী বলুন।
- উফ, তুমি বড় বাড়তি কথা বলো মন্টু।
- বিধুস্যার...। মেরে ফেলবেন না। শুনেছি মরে যাওয়ায় বড় কষ্ট। ব্যথাট্যাথা লাগে, দুঃখটুঃখ হয়। তার চেয়ে না হয় আরও দু'দিন না খাইয়ে রাখুন।
- চোপ!
- সরি। আমি চুপ।
- এ'বার যা বলছি, সে'টা মন দিয়ে শোন। তোমায় আমার একটা কাজ করতে হবে।
- রেশন তুলে দেব? সর্ষের তেল দিয়ে কষে গা মালিশ করে দেব? ভাতে-ভাত রান্না করে দেব?
- ফের বাজে কথা বলে। আগে শোনো...।
- বলুন স্যার।
- তোমায় আমার হয়ে পকেট মারতে হবে।
- আপনার হয়ে?
- আমার হয়ে।
- আপনি এ লাইনেও তবে...। মানে, আমি তো জানতাম বিধু মাস্তান মানেই উঁচু দরের কাজ। তোলা আদায়। ভাঙচুর। ইয়ে, কিডন্যাপিং।
- লাইন আমি চেঞ্জ করিনি। তবে একটা সূক্ষ্ম কাজ আছে। সে'জন্য আমার তোমায় প্রয়োজন।
- হুকুম করুন না। কার পকেট মারতে হবে বলুন। দারোগার? প্রাইম মিনিস্টারের?
- মনোজ সামন্ত। সে তো তোমার পাড়ারই লোক, তাই না?


- মনোজ মাস্টার? হাইস্কুলে এককালে অঙ্ক পড়াতেন? ও মা, ও বুড়োর পকেট কেটে পাবেনটা কী। তার নিজেরই খাওয়াপরার ঠিক নেই।
- আমি যা বলব, তাই করবে। তার বাইরে কিস্যুটি নয়।
- আচ্ছা বেশ, এ'বার ছেড়ে দিন। আজ বিকেলের মধ্যেই মনোজ মাস্টারের পকেট ফাঁক।
- ফাঁক করলে হবে না মন্টু।
- এই সেরেছে। পকেট মারতে বললেন তো।
- মনোজ মাস্টারের পকেট থেকে ওর মানিব্যাগ সরাবে। সে মানিব্যাগে একটা দু'হাজার টাকার নোট রাখবে। তারপর সে মানিব্যাগ মাস্টারমশাইয়ের পকেটে রেখে সরে পড়তে হবে।
- এই আপনার মতলবটা কী বলুন তো...।
- এ কাজের জন্য তুমিও পাঁচশো টাকা পাবে। প্রতি হপ্তায় এ কাজ একবার করে করতে হবে। প্রতি হপ্তায় তোমার পকেটে পাঁচশো।
- ঠাট্টা করছেন স্যার?
- এই যে, কড়কড় আড়াই হাজার টাকা। রাখো।
- মাস্টারকে সোজা গিয়ে টাকা দিলেই তো হয়।
- মাস্টারমশাই তো আমার থেকে টাকা নেবেন না।
- আপনার অত পিতলে পীরিতের দরকারটাই বা কি?
- ভদ্রলোক আমায় বিনে পয়সার পড়িয়েছেন বহুবছর। অনেক চেষ্টা করেছিলেন একসময় আমায় মানুষ করতে। তবে আমার বখে যাওয়াটা রুখতে পারেননি। ইদানীং শুনলাম বড় অভাবে পড়েছেন। ওর ছেলেটা মারা গেছে। স্ত্রী অসুস্থ। এ বয়সে বাড়ি বাড়ি ছাত্র পড়িয়ে তেমন ম্যানেজ দিতে পারছেন না। তাই ভাবছিলাম আমার ঋণ খানিকটা শোধ করব।
- কিন্তু স্যার...।
- কোনও কিন্তু নয়...।
**
বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো মন্টুর। এ কী! তাঁর নিজের পকেট থেকে মানিব্যাগ হাওয়া? সর্বনাশ! কিন্তু মন্টু বিশেষ কিছু ঠাহর করার আগেই টের পেল পকেটে আবার ওজন ফেরত এসেছে; ও মা! এইত্তো ফিরে এসেছে মানিব্যাগ! ভোজবাজি নাকি মনের ভুল? ভরদুপুরবেলা হাটেবাজারে এমনটা হল? আচমকা পিঠে একটা নরম টোকা পেয়ে স্যাট করে ঘুরে তাকাল সে।
- কে? এ কী! মনোজ মাস্টার যে!
- নিজেকে খুব লায়েক ভাবিস তুই, তাই না মন্টু?
- না মানে...মাস্টারমশাই...শুনুন...এই কান ছাড়ুন না...এ কী।
- আমি গোড়াতেই বুঝেছিলাম যে প্রতি রোববার বাজার থেকে ফেরার পথে আমার মানিব্যাগে একটা দু'হাজার টাকার নোট উড়ে এসে জুড়ে বসে কী করে। শোন ব্যাটা! অঙ্কমাস্টার আমি, ঘাসে মুখ রেখে চলিনা। ওই লেভেলে পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে ফেরত রাখার এফিশিয়েন্সি যে শুধু তোর আছে সে'টাও আমি আঁচ করেছিলাম গোড়াতেই।
- ও মাস্টারমশাই, মাস্টারমশাই গো! পুলিশে দেবেন না প্লীজ...আমি কিন্তু ঠিক চুরি করিনি...বরং উলটোটা...।
- শাটাপ। আমায় চ্যারিটি করতে এসেছিস? তাও ওই গুণ্ডামাস্তানের টাকায়? তক্কে তক্কে ছিলাম শায়েস্তা করার। দিনের পর দিন প্র্যাক্টিস করেছি, যাতে খেল আমিও দেখাতে পারি।
- প্র্যাক্টিস?
- গত দেড় মাসে আমায় বারো হাজার টাকা দিয়েছিস, মানে ওই বিধুমাস্তানের দান আর কী। তোর পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে, তা'তে ছ'টা দু'হাজার টাকার নোট ফেরত রেখে ফের তোর পকেটে চালান করেছি। কী, কাজটা স্মুদলি করেছি তো? মন্টু পকেটমারের স্কিল ম্যাচ করতে পেরেছি তো?
- আজ্ঞে মাস্টারমশাই, লজ্জা দেবেন না...।
- শোন মন্টে, প্র্যাক্টিসে অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। ঠিক সময়ে অঙ্কটা সাফিশিয়েন্টলি প্র্যাক্টিস করলে আজ বিধুর এ'অবস্থা হত না। ছি ছি, মাস্তানির টাকায় নিজের মাস্টারের উপকার করবে? কী দুঃসাহস।
- আমার কোনও দোষ নেই, আমায় ছেড়ে দিন প্লীজ।
- তোকে ছেড়ে না দিলে তুই বিধুর মুখে ওই বারো হাজার টাকা ছুঁড়ে মারবি কী করে! আর শোন, বিধুকে বলে দিস যে বুড়ো শিক্ষকের প্রতি অত দরদ থাকলে যেন একদিন বাড়ি গিয়ে প্রণাম করে আসে। ও গুণ্ডা হলেও আমার ছাত্র। সে রাইট ওর আছে।
- বলে দেব। বলে দেব মাস্টারমশাই।
- আর এও বলে দিস, যে সে নিজে না এলে আমি তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসে কান মুলবো। প্র্যাক্টিসে যে কী সম্ভব তা তো নিজের চোখেই দেখলি। এক মাসের প্র্যাক্টিসে তোর মত পকেটমারের পকেট যদি মারতে পারি, তা'হলে চেষ্টাচরিত্র করে কিডন্যাপিংয়েও বিধুর ওপর বাটপারি করাটা ইম্পসিবল নয়।
- আপনি যা যা বললেন,মুখস্থ করে নিয়েছি। বিধু স্যারের কাছে গিয়ে এক্কেরে উগরে দেব। এ'বার আসি?
- যাবি? দাঁড়া। এই ভরদুপুরে তোকে ধরে-বেঁধে এত জ্ঞান দিলাম। যাওয়ার আগে অন্তত দুটো রসগোল্লা খাওয়াই। চ'সমরের মিষ্টির দোকানে গিয়ে বসি খানিকক্ষণ। বিধু কেমন আছে সে খোঁজখবর একটু নেওয়া দরকার।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু