Skip to main content

বিনোদবাবু আর আদা-চা



মার্ক অ্যান্ড ডগলাস কোম্পানির ফাইলটা ছুঁড়ে ফেললেন বিনোদবাবু। ফাইলের ভিতরের কাগজগুলো এলোমেলো হয় ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল৷ টানা আড়াইমাস বড় খেটেখুটে প্রপোজালটা তৈরি করেছিলেন৷ নিখুঁত ভাবে সাজানো প্ল্যান৷ মার্ক অ্যান্ড ডগলাসের পারচেজ ম্যানেজার মিস্টার পোদ্দার সে প্রপোজালে একবার নজর বুলিয়েই বলেছিলান, "বিউটিফুলি ডান"। সিনহা সাহেব বিনোদবাবুর পিঠ চাপড়ে পোদ্দারকে বলেছিলেন, "বিনোদ আমাদের অ্যাসেট৷ ও' যখন উঠেপড়ে লেগেছে, আপনার কোনও চিন্তাই নেই"৷ বিনোদবাবুর সেই প্রপোজালটা আজ পাস হয়ে গেল, কিন্তু প্রজেক্ট সামলানোর দায়িত্ব পেল সৌম্য দত্ত৷  প্রতিবাদ করেছিলেন বিনোদবাবু, কিন্তু লাভ হয়নি৷ বরং সিনহা সাহেব দাঁত চেপে বললেন যে বিনোদবাবু যেন 'নুইসেন্স ক্রিয়েট' না করেন৷ 

অভয়চরণ আদা দেওয়া চা নিয়ে এসেছিল, মুখঝামটা দিয়ে তাকে কফি আনতে বললেন বিনোদবাবু৷ হতবাক অভয়চরণ কথা বাড়ায়নি৷ ছেলেটা এমনিতেই বেশ নম্র। এরপর  কম্পিউটারে বসেই বিনোদবাবু দেখলেন সিনহা সাহেব ইমেলে নতুন প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরির হুকুম দিয়েছেন।  মেজাজটা আরও ঘেঁটে গেল৷ ইনবক্স বন্ধ করে পায়চারি শুরু করলেন তিনি৷ বয়ে গেছে এমন বিচ্ছিরি পরিবেশে দিনরাত খাটতে৷ বিনোদবাবু মনস্থ করলেন এ'বার থেকে তিনক মনপ্রাণ দিয়ে কাজে ফাঁকি দেবেন। 

হ্যাঁ! ফাঁকি দেবেন৷ সিনহাদের দল বুঝুক ঠ্যালা৷ কিন্তু কী'ভাবে ফাঁকি দেবেন কাজে? চট করে মোবাইলে মিনিট চারেক লুডো খেললেন৷ কিন্তু সে'ফাঁকিটা তেমন মজবুত মনে না হওয়ায় কম্পিউটারের দিকে খামোখা তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ৷ তারপর মনে পড়ল হরপ্রসাদের কথা৷ অ্যাকাউন্টসে কাজ করে। কিন্তু নিজের সীটে তাকে  দেখাই যায়না, দিনরাত শুধু অফিসের বাইরের চায়ের দোকানে গিয়ে চা-মামলেট খাচ্ছ আর বিভিন্ন আড্ডিয়ে দলের সঙ্গে আড্ডা জমাচ্ছে৷ সমস্ত ফিচেল আড্ডার মধ্যমণি হরপ্রসাদ কারণ সে  হল অফিস গসিপের চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া৷ 

যথারীতি সেই চায়ের দোকানের বেঞ্চিতেই পাওয়া গেল হরপ্রসাদ ধরকে৷ গলায় আই-কার্ড, ঠোঁটে সিগারেট, চোখে ঝিলিক৷ দু'জন নতুন ছোকরাকে গ্লোবাল ইকনমি নিয়ে দেদার জ্ঞান দিচ্ছিল৷ বিনোদবাবুকে চা-মামলেটের অর্ডার দিতে দেখে এক গাল হাসি নিয়ে এগিয়ে এলো হরপ্রসাদ; "এ কী! বিনোদদা এ'সময় এ'দিকে? স্প্রেডশিট থেকে চোখ সরাবার সময় পেলেন এদ্দিনে"?

আড়াই সেকেন্ড হে-হে করে হরপ্রসাদের পাশে এসে বসলেন বিনোদবাবু৷ হরপ্রসাদ তার ইকনমিক লেকচারে ফেরত গেল৷ বিনোদবাবু বুঝলেন যে এ আড্ডায় সবচেয়ে বড় সুবিধে হচ্ছে বেশি কথা না বললেও চলে কারণ হরপ্রসাদের কথা শেষ হয়না৷ এই ভালো; আড্ডাও হল, অসময়ে মামলেটও হল, আবার কাজে ফাঁকিও দেওয়া যাচ্ছে৷

ভিয়েতনামের ইকনমি থেকে হরপ্রসাদের মনোলগ যখন কানাডার ফিসকাল পলিসিতে পৌঁছেছে,  তখনই বিনোদবাবুর মোবাইলে বেজে উঠল, কনিষ্ঠ পুত্রটি ফোন করেছে, গত মাসে তার পাঁচ  বছর পূর্ণ হয়েছে৷ অতএব সে এখন লায়েক হয়েছে।

"বাবা! তুমি কী করছ"? 

বিনোদবাবুর মুখের মামলেটটা সুট করে বিস্বাদ ঠেকল৷ প্লেটটা নামিয়ে রেখে তড়াং করে উঠে দাঁড়ালেন৷ হরপ্রসাদের লেকচারে ছন্দপতন ঘটল৷ নতুন শ্রোতা হারানোর ভয় বড় সাংঘাতিক৷ 

- ও কী বিনোদদা, চললেন কই? অমলেটটা শেষ করুন৷ আর চা তো আসেইনি৷ আমাদের নির্মল লেবুচা-টা যা বানায় না, এ-ক্লাস৷ আরে বসুন না, এই তো এলেন।

- আসলে হঠাৎ মনে পড়ল, বুঝলে, একটা আর্জেন্ট রিপোর্ট শুরু করতে হবে। দেরী হলেই আবার..।

- কেন এত চাপ নিচ্ছেন৷ রিপোর্ট বানাবেন আপনি। আর প্রজেক্ট পাবে মৃণাল সিনহার পেয়ারের ওই সৌম্য দত্ত। ছাড়ুন না৷ তারচেয়ে বরং জ্যাপানের ইকনোমিক মডেলের ব্যাপারে একটা অদ্ভুত গল্প বলি শুনুন..।

- সৌম্য ইয়ং এনার্জেটিক চ্যাপ৷ কাজ পাক না, ক্ষতি কী৷ আমি বরং আসি৷ মামলেট আর জ্যাপান পরে হবে'খন৷ 

নিজের অফিসঘরে এসেই মেঝেয় ছড়িয়ে থাকা মার্ক অ্যান্ড ডগলাসের কাগজগুলো যত্ন করে ফের ফাইলে গুছিয়ে রাখলেন তিনি৷ অভয়চরণ কফি রেখে গেছিল, ঠাণ্ডা হয়ে গেছে৷ "অভয়" বলে একটা পেল্লায় হাঁক পাড়লেন বিনোদবাবু৷ অভয় এলে তিনটে কাজ সারতে হবে।

এক নম্বর, অকারণ খারাপ ব্যবহার করার জন্য অভয়কে একটা জবরদস্ত 'সরি' বলতে হবে।
দু'নম্বর, আদা দেওয়া চা এক কাপ চাইতে হবে।
তিন নম্বর, মার্ক অ্যান্ড ডগলাস কোম্পানির ফাইলটা অভয়চরণের হাত দিয়ে সৌম্যর কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে৷ ওর বেশ কাজে লাগবে৷ 
অভয় আসার আগেই সে ফাইলে একটা হলুদ স্লিপ এঁটে একটা "অল দ্য বেস্ট" লিখলেন বিনোদবাবু৷

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু