Skip to main content

ডিভাইডেড আইল্যান্ড



কিছুদিন আগে ফ্যামিলি ম্যান -২ দেখলাম৷ টানটান, ঝকঝকে; ওই যাকে আমরা বলি "অ্যাকশন প্যাকড"৷ আর পাঁচজনের মত আমারও ভালো লাগল৷ সে'খানেই দাড়ি টেনে দিলে হত৷ কিন্তু সেই সিরিজের অন্যতম প্রধান চরিত্র রাজিকে ছুঁয়ে আগ্রহের নিশানা গিয়ে ঠেকল শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে৷ সে বিষয় নিয়ে একটা আলগা ধারণা যে ছিল না তা নয়৷ ওই তামিল ইলম, এলটিটিই, প্রভাকরণ ইত্যাদি৷ এলটিটিইকে দুরমুশ করে যুদ্ধে ইতি টানা হয়েছে, নিউজচ্যানেল এবং ইন্টারনেটের বদান্যতায় তাও খানিকটা জানা ছিল৷ অবশ্য শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের বাইরে সে'খানকার ইতিহাস সম্বন্ধে তেমন আগ্রহ এর আগে টের পাইনি৷ শেষে একটা ওটিটি থ্রিলার সে আগ্রহটা সামান্য উস্কে দিল৷ আমি যে কোম্পানিতে কাজ করি, তাদের অফিসপাট রয়েছে শ্রীলঙ্কায়। কাজেই শ্রীলঙ্কায় কিছুদিন চাকরী করে আসা কিছু মানুষজনকে চিনি৷ কলোম্বোর জীবন সম্বন্ধে খানিক গল্পগুজবও জুড়েছি তাদের সঙ্গে কয়েকবার৷ তবে অফিস পরিসরে যা ঘটে, গল্প-আলোচনা গভীরে পৌঁছয় না৷ 

এই বইটার খোঁজ দিল আমার শ্রীলঙ্কা-বিশেষজ্ঞ বন্ধু সুহেল৷  বই জোগাড় হল। পড়াও হল৷  গোড়াতেই সহজ কথাটা বলে দেওয়া যেতে পারে। এ বই না পড়লেই নয়৷ শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে আগ্রহী না হলেও, মানুষের মানুষামি এবং অমানুষামি সম্বন্ধে সচেতন হওয়ার জন্য এ বই প্রায় মেড-ইজি-গাইডের মত৷ ক্ষুরধার সাংবাদিকতার সঙ্গে গভীর সংবেদনশীলতা না মিশলে এমন লেখা বোধ হয় সম্ভব নয়৷ শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের নির্মম ইতিহাস পরিপাটি ভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন সামন্থ। গোটা বইটাই উঠে এসে সাধারণ মানুষের কথায় ভর দিয়ে। সে দেশের আনাচেকানাচে ঘুরে, বহু মানুষকে বড় কাছ থেকে চিনে, তাঁদের জ্বালা-যন্ত্রণাকে পাশে থেকে অনুভব করে এই বই লিখেছেন সামন্থ৷ আর ভদ্রলোকের লেখার সবচেয়ে বড় গুণ হলো 'ব্যালেন্স'৷ টাইগার আর সিংহ; দু'দলেরই গোলমেলে দিক নিয়ে নির্দ্বিধায় আলোচনা করা হয়েছে এ বইয়ে৷ এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এতটা ব্যালেন্সড লেখা বেশ একটা অসাধ্যসাধন করা ব্যাপার৷ 

কিছু গা-কাঁপানো ব্যাপার সামন্থের ঈর্ষনীয় ডিটেলিংয়ের মাধ্যমে উঠে আসেঃ

- যুদ্ধের পাগলামি কাউকেই রেয়াত করেনা।

- দুর্বলের প্রতি চড়াও হওয়ার পাশবিক বাসনা মানুষের মজ্জাগত, এর অন্যথা কোনওদিন ঘটেনি, ঘটবেও না৷ আমাদের যাবতীয় ইন্টেলেক্ট আর সভ্যভব্য বাতেলার আড়ালে একটা পাশবিক মব-মেন্টালিটি লালন করে চলা ধান্দাবাজ বসে আছে৷ ধান্দাবাজিটুকুই সিভিলাইজেশন বোধ হয়; মমনমোহন মিত্তির অন্তত ঠারেঠারে তেমন কিছুই বলতে চেয়েছিলেন৷ 

- আমরা সবাই স্রেফ সুযোগের অভাবে অন্যের বুকে ছুরি বসিয়ে মুনাফা লুটছি না৷ আওয়ার ভালোমানুষি ইজ প্রবাবলি দ্য অভাব অফ সুযোগ৷

- ভেঙেচুরে যাওয়া হেরো মানুষদের ঝাড়পোছ করে সাফ করে দিতে পারাটাই ইতিহাস। (সামন্থ পেরেছেন অ-ইতিহাসটুকু নিয়ে কথা বলতে, সে'খানেই এই বই সার্থক)।

যাকগে৷ লাইক আ ট্র‍্যু ঢেঁকি ধান-ভাঙিং ইন স্বর্গ; শ্রীলঙ্কা আর বাংলার যোগাযোগ নিয়ে দু'টো ট্রিভিয়া দিই (অবশ্যই এ বই থেকে ধার করে)ঃ

প্রথমত, 
রাজপুত্র বিজয় সিংহের কথা৷ এ'টা হয়ত অনেকরই জানা৷ সাতশোজন অনুচর নিয়ে বিজয় সিংহ প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে শ্রীলঙ্কায় পৌঁছন৷ সেই বিজয় সিংহ থেকেই সিংহলদের যাত্রা শুরু৷ এ' ভদ্রলোকের বাপের রাজত্ব নাকি ছিল বাংলায়। ক'দিন আগে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন নিয়ে খানিকটা পড়েছিলাম, তিনিও এই বিজয় সিংহের লঙ্কাকাণ্ড নিয়ে ফলাও করে একটা মহাকাব্য লেখার ছক কষেছিলেন (শেষমেশ  সে লেখা অবশ্য এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি)। 

দ্বিতীয়ত,
সত্যজিতের গল্প৷ এ যোগাযোগটা একটু প্যাঁচালো তবে ব্যাপারটা বড় সুন্দর৷ বিজয় সিংহের লঙ্কা আগমনের পর হাজার দুই বছর কেটে গেছে৷ একদিন, সাংবাদিক ও কার্টুনিস্ট প্রগিথ একনালিগোডা (বানানটা বাংলায় ঠিক লিখলাম না হয়ত, ইংরেজিতে Prageeth) মন দিয়ে সত্যজিৎ রায়ের একটা স্কেচ আঁকছিলেন৷ ঘটনাচক্রে ঠিক সেই সময়ই একটা বিশেষ প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন এক এনজিওর কর্মী সন্ধ্যা। সেই প্রথম তাঁদের আলাপ৷ আলাপ থেকে বন্ধুত্ব, প্রেম, সাদামাটা বিয়ে আর প্রবল ভালোবাসার সংসার৷ প্রগিথ আর সন্ধ্যা তাঁদের প্রথম ছেলের নাম রাখা রেখেছিলেন সত্যজিৎ; নিজেদের প্রথম আলাপের কথা মনে রেখে৷ ঘটনাচক্রে,  সেই সত্যজিতের জন্মও হয়েছিল ২-মে৷

এই প্রথম ও দ্বিতীয় ঘটনাটির মাঝখানে শ্রীলঙ্কার বড় হয়ে ওঠা, বুড়িয়ে যাওয়া, এবং আর পাঁচটা দেশের মতই; বিষিয়ে যাওয়া। সরকারের না-পসন্দ কথাবার্তা নিজের আঁকা ও লেখার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছিল প্রগিথ৷ বিভিন্ন হুমকি অগ্রাহ্য করে যুদ্ধের বিরুদ্ধে লেখালিখি শুরু করেছিল সে৷ একের পর এক হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করার মাশুল তাকে অবশেষে দিতে হয়৷ আচমকা একদিন কাজের শেষে আর বাড়ি ফেরা হয়না প্রগিথের৷ বাতাসে মিলিয়ে যায় সে; সরকার বিরোধী সমস্ত প্রতিবাদের যেমন দশা হওয়া উচিৎ আর কী৷ শ্রীলঙ্কার সেই সত্যজিতের বাবা আর ফেরেননি৷

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু