Skip to main content

বোধদয়



স্যাঁতসেঁতে একটা ঘর৷  একটা দেওয়ালে পাশাপাশি দু'টো ক্যালেন্ডার, একটা বাংলা আর একটা ইংরেজি৷ মা তারা হার্ডওয়্যার স্টোর্সের বাংলা ক্যালেন্ডারটা চার বছর পুরনো, গ্রীনপ্লাইয়ের ইংরেজিটা বছর দুই আগের৷ টিউবের আলোতেও ঘরের ঘোলাটে ভাব কাটছে না। হলুদ দেওয়ালগুলো বেশ বিবর্ণ৷ যে দেওয়ালে ক্যালেন্ডার-জোড়া ঝুলছে, তার উলটো দিকের দেওয়ালে একটা অজন্তার দেওয়াল ঘড়ি৷ ঘড়িটা বন্ধ৷ তবে সময়টা সন্ধ্যের পরেই হবে। 

সে ঘড়ির নীচেই ঘরের একমাত্র জানালা, সে'টা বন্ধ৷ জানালা ঘেঁষে রাখা একখানা টেবিল যার বয়স অন্তত আশি হওয়ার কথা৷ সে টেবিলের ওপর বইয়ের স্তুপ। আর একটা কলমদানি। আর একটা টেলিফোন। ঘরের আসবাব বলতে একটা চৌকি, আর দু'টো আলমারি৷ একটা আলমারি স্টিলের, অন্যটা কাঠের৷ কাঠের আলমারিটাও বইয়ে বোঝাই৷ 

 সেই স্টাডি টেবিলের সামনে একটা চেয়ার৷ সে চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক৷ মাথায় যে ক'গাছা চুল পড়ে রয়েছে তার অর্ধেকের বেশিই পাকা কিন্তু মুখ দেখলে মালুম হয় যে বয়স নিশ্চয়ই বাহান্নর বেশি নয়৷ পরণে হাফ শার্ট আর পাজামা৷ 

আচমকা৷ 
ঘরের দরজাটা ঘটাং শব্দে খুলে গেল আর ভদ্রলোকের ঝিমুনি গেল চটকে। ঘরে ঢুকল এক ছোকরা গোছের ছেলে, বয়স বাইশ চব্বিশের বেশি হবে না৷ হালকা গোঁফ, বাহারি টেরি আর তার কালো টিশার্টে একটা হলুদ বেড়ালের ছবি৷ ছোকরার হাতে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট। 

চেয়ারে বসা ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠলেন।

- ঘরে ঢোকার আগে নক করতে হয় রে রাস্কেল!

- আরে মামা! তুমি এখন সে'সব ছেঁদো এটিকেটের থেকে অনেক দূরে চলে গেছ। রিল্যাক্স।

- ফের শুরু হল যত অলুক্ষুণে কথাবার্তা৷

- ট্রুথ ইস নট অলুক্ষুণে মামা৷

- যত আগডুমবাগডুম৷ কতবার বলেছি আমায় জ্বালাতে আসিস না।

- না এসে উপায় কী? তুমি এ ঘর ছেড়ে না বেরোলে আমাদের লাইটইয়ার্স ক্লাবের ঘর হিসেবে এ'টাকে ব্যবহার করব কী করে বলো। 

মামা এ'বার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন৷ 

- এ ঘরে আমি আঠাশ বছর ধরে আছি৷ এ ঘর  আমি ছাড়তে যাব কোন দুঃখে রে হারামজাদা?

- ল্যাঙ্গুয়েজ মামা। প্লীজ। ল্যাঙ্গুয়েজ।

- দ্যাখ পটা, তোর এই বদমায়েশি আমি অনেকদিন ধরে সহ্য করছি৷ প্র‍্যাক্টিকাল জোক খানিকক্ষণ ভালো লাগে তবে এ'টা জাস্ট সমস্ত লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছে৷

- আচ্ছা ঝামেলা তো। নিজে মরে ভূত হয়ে এ ঘর আটকে বসে আছ!অথচ সে'টা বললেই দোষ?

- দিব্যি বই পড়ছি, পোয়েট্রি লিখছি৷ আর তুই ব্যাটা এ ওবেলা এসে এ'সব রিউমর ছড়িয়ে যাচ্ছিস৷ আমি তোকে পুলিশে দেব।

- ছ'মাস আগেই পটল প্লাক করে ফেলেছ মামা৷ এমন ঢ্যাঁটামোর কোনও মানে হয়? 

- মহাঝ্যামেলা। দিব্যি বেঁচেবর্তে আছি৷ এই দ্যাখ, পিঠে ঘামাচিও বেরোচ্ছে।

- ও'সব তোমার মনের ভুল৷ হাবুল তান্ত্রিক এসে বারবার তোমায় রিয়ালিটিটা জানিয়ে যাচ্ছে অথচ তোমার সুবুদ্ধি উদয় হচ্ছে না৷ 

- হাবুলটা একটা ফোর টুয়েন্টি৷ ফ্রড৷ তুই জানিস এককালে সে লোক ঠকিয়ে এক জালি কোম্পানির ইন্স্যুরেন্স গছাতো মানুষকে?

- এখন হাবুলদা রিফর্মড মানুষ মামা৷ কেবল-টিভিতে বসে প্রতি অমাবস্যার রাত্রে লোককে কনসাল্ট করে৷ মেজমাসী বলে ধন্বন্তরি।  

- বুল্টিটা একটা গবেট৷ 

- মামা, আবারও বলছি। ছ'মাস হল৷ সেরিব্রাল। ম্যাসিভ৷ এ'বার এ ঘরটাকে হন্টেড করে না রেখে মানে মানে সরে পরো দেখি৷ লাইটইয়ার্স ক্লাবের ফিউচার নষ্ট করছ তুমি৷ এই ঘরটা বাগাতে পারলে আমি ক্লাবের সেক্রেটারি হব, সেটিং করা আছে।

- আরে মহামুশকিল। নিজের আখেরের জন্য জ্যান্ত মানুষকে মড়া বলবি?

- ইউ আর অনলি অ্যান আত্মা।

- দ্যাখ, ফের যদি তুই হাবুলকে এনেছিস..।

- না মামা। আমি হাবুলের চেয়েও এফেক্টিভ প্রমাণ এনেছি৷ 

- প্রমাণ? আমি মারা গেছি তার প্রমাণ? 

- অকাট্য।

লায়েক ছোকরাটি প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে একটা সাদা কাগজের বাক্স বের করে সে'টা মামার সামনে টেবিলের ওপর রাখে৷

- এ'টা কী রে?

- এ'টাই প্রমাণ। যে তুমি মৃত।

- ইয়ার্কি হচ্ছে?

- আগে বলো, সর্দি হয়েছে তোমার?

- না৷ ন্যাসাল প্যাসেজ ক্লীন৷ 

- মনের মধ্যে আচমকা ফুর্তি টের পাচ্ছ?

- নট অ্যাট অল। এ'সব কী রকমের হেঁয়ালি?

ভাগ্নে চোখ গোলগোল করে এগিয়ে এলো মামার দিকে। 

- কোনও সুবাস পাচ্ছ না মামা?

- নাথিং৷ তা'তে কী?

পি সি সরকারের মত বরফ গলানো হাসি ভাসিয়ে পটা ফের জিজ্ঞেস করলে;

- কোনও গন্ধই কি পাচ্ছ না? মনে কি কোনও আনচানই নেই?

- নেই! আরে খুলে বল না কাঁচকলা!

উত্তর না দিয়ে পটা এগিয়ে এসে সে কাগজের বাক্সের ঢাকনাটা খুলে দিল। 

বাক্সের ভিতরে তাকিয়ে থমকে গেলেন মামা। গলার স্বর বুজে এলো৷ চোখ ছলছলিয়ে উঠল৷ কাঁপতে কাঁপতে সে বাক্সের ওপর ঝুঁকে পড়লেন তিনি৷ কয়েক ফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়েও ম্যাজিকের মত গায়েব হয়ে গেল। উদ্ভ্রান্তের মত মাথা নাড়তে লাগলেন তিনি। 

আর পটা বিকট ভঙ্গিতে নাচতে শুরু করলে, যেন সে ঠাকুর বিসর্জনে চলেছে আর মাইকে লারেলাপ্পা গান বাজছে৷ 

খানিক পর মামাই অস্ফুটে বলে উঠলেন;

- আ...আমি..আমি বিরিয়ানির সুবাস পেলাম না?

- দ্যাট ট্যু মামা, আরসালানের বিরিয়ানি। প্যাক করিয়ে ডাইরেক্টলি নিয়ে আসছি।

- আমি বিরিয়ানির সুবাস পেলাম না!

- বিলকুল পেলে না।

- বিরিয়ানির সুবাস পেলাম না৷ মনটা আনচান করে উঠল না। বুকের মধ্যেও নো-মোচড়!

- পেলে না৷ উঠল না। মোচড়ালো না।

- আমি সত্যিই মরে গেলাম রে পটা৷ এমন এলেবেলে ভাবে? জাস্ট মরে গেলাম?

- জাস্ট মরে গেলে মামা।

- ক্লাবঘর করবি কর। বইগুলোর অযত্ন করিস না। কেমন? 

- যো হুকুম মামা৷ এ'বার এসো দেখি৷ দুগ্গা দুগ্গা!

মামার চেহারাটা আবছা হয়ে আসছিল৷ আর ও'দিকে পটা ততক্ষণে 'বলো হরি হরি বোল' ডিস্কো সুরে গাইতে গাইতে বিকট নাচ শুরু করেছে।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু