Friday, March 29, 2019

ভেক


- অত কী ভাবছেন?

- কে?

- আমি যেই হই, এই খাদের ধারে দাঁড়িয়ে অত চিন্তাভাবনায় কাজ কী দাদা। মাঝরাত্তিরে এসেছেন সুইসাইড পয়েন্টে। ঠিক যেমনভাবে প্রতি মাসে জনা তিনেক করে আসে। তবে এত ভাবনাচিন্তা করছেন মানে গোলমাল আছে। অর্থাৎ ইচ্ছে আছে কিন্তু কনফিডেন্স নেই।

- ফালতু জ্ঞান ঝাড়া বন্ধ করে কেটে পড়ুন। আমি সুইসাইড করি, এ'খানে বসে সাপলুডো খেলি বা ঘুড়ি ওড়াই; সে'টা একান্তই আমার পার্সোনাল ব্যাপার।

- ঝাঁপের পর আর পার্সোনাল বলে কিছু থাকে কি?

- আমি ঝাঁপ দি আর না দি; তা'তে আপনার কিছু বিগড়োবার কোনো কারণ নেই। এতরাত্রে আপনি এ'খানে কী করছেন?  নিশ্চয়ই সুইসাইড করতেই এসেছেন? তা'হলে বিনাবাক্যব্যয়ে এগিয়ে যান। ঝাঁপ দিন।

- গত পরশুই ওই ঝাঁপ দেওয়ার কাজটা আমি সেরে রেখেছি,  বুঝলেন?

- ইয়ার্কি করছেন?

- মড়া হতে পারি। হাড়বজ্জাত নই। এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে ফচকেমো করব না। ওহ আমার পরিচয়টা দিয়ে নিই। আমি আনন্দ পাল। ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট; ছিলাম। কাজকর্ম ভালোই চলছিল, শুধু প্রেমটা ঝুলে যাওয়ায় এ কাজটা করে ফেলি। জাস্ট উত্তেজনার বশে ব্যাপারটা ঘটে গেছিল, জানেন।

- তো আপনি তা'হলে ভূত? আনন্দবাবু?

- আজ্ঞে। এমন দুম করে উদয় হলাম বলে কিছু মনে করবেন না প্লীজ। আচ্ছা আপনার নামটা?

- আমি উদয়ন সেন।

- সুইসাইডের জন্যই এসেছিলেন, তাই না?

- চাকরীটা এমন দুম করে...। বাড়িতে বাবা, মা, বৌ, দুই ছেলে; এ'দিকে বাজারে প্রচুর ধারদেনা। ভাবছিলাম, পালিয়ে যাওয়াটাই সুবিধের ব্যাপার হবে।

- তেমনটা ভেবেই আমিও এসেছিলাম। লাফও দিয়েছি, তবে মরে বড্ড আফশোস হচ্ছে উদয়নবাবু। ইনফ্যাক্ট নীচে যাদের সঙ্গে আলাপ হল, তাঁরা কেউই তেমন নিশ্চিন্দিতে নেই।

- নীচে...নীচে তেনাদের...মানে আপনাদের জমায়েত?

- সরগরম একেবারে।

- ঝাঁপ দিয়েও তা'হলে রেহাই নেই আনন্দবাবু?

- কাঁচকলা। যে তিমিরে সেই তিমিরেই।

***

উদয়ন সেন যখন সুইসাইড পয়েন্টের দুর্বিষহ অন্ধকার পেরিয়ে বড় রাস্তার ঘোলাটে আলোয় মিলিয়ে গেলেন তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আনন্দ পাল। সুইসাইড পয়েন্টের ফাঁকা বেঞ্চিটায় গা এলিয়ে দিলেন। এখনও সে'দিনটার কথা মনে করে গা শিউরে ওঠে তার। এমনভাবেই শেষ মুহূর্তে নিজেকে খাদের ধার থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি, আজ থেকে বছরখানেক আগে। উদয়নবাবুর মতই সুইসাইড পয়েন্টের ঘোলাটে অন্ধকার ছেড়ে বড় রাস্তার আলোয় গিয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেই ফিরে আসতে পারা উদয়ন জানেন যে আত্মহত্যার মুখে মানুষকে একবার সামান্য হোঁচটের মুখে দাঁড় করালেই তার সিদ্ধান্ত সমূলে কেঁপে উঠবেই। এ'ভাবেই অন্তত শ'খানেক মানুষকে আত্মহত্যার চরম সিদ্ধান্ত থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সবাইকে আটকানো সম্ভব না হলেও কিছু মানুষকে রুখে দেওয়া যায়; আজ যে'ভাবে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরানো গেল উদয়ন সেনকে। শুধু এ কাজের জন্য তাঁকে ভূত সাজতে হয়; যাক গে, সে'টুকু করাই যায়।

একটা প্রবল পরিতৃপ্তি অনুভব করছিলেন আনন্দ পাল।

***

রাস্তার আলোয় গায়ে এসে পড়তেই মিলিয়ে গেলেন উদয়ন সেন।  আর মিলিয়ে যেতেই তাঁর ছায়াছায়া আকৃতিটা ভাসতে ভাসতে নেমে গেল খাদের নীচে; খাদের মাথাতেই এ অঞ্চলের কুখ্যাত সুইসাইড পয়েন্ট। সে'খানে একটা কাঠের বেঞ্চি যার ওপর ছায়ার মত এলিয়ে বসে রয়েছে আনন্দ পাল। বেচারা আনন্দ আজও টের পায়না যে সে সত্যিই ভূত। সত্যিই সে আত্মহত্যা করতে পেরেছিল। খাদের নীচে যে'খানে ভূতের আড্ডা; সে'খানে আনন্দ পালের আত্মা কিছুতেই নেমে আসতে পারেনি। সে সেই বেঞ্চিতেই আটকে। অন্য ভূতেরা আনন্দকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে কিন্তু উদয়নের মনটা বড্ড নরম৷ বারবার তিনি ওপরে উঠে আসেন আনন্দকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে কিন্তু মনের কথা বলার আগেই আনন্দ তাঁকে জ্যান্ত ঠাউরে সুইসাইড আটকাতে উদ্যত হয়। এবং তার জন্য সে'আবার ভূতের ভেক ধরার চেষ্টা করে। হাস্যকর অথচ হৃদয়বিদারক।

উদয়ন বার বার উঠে আসে আনন্দকে বোঝাতে যে এ ভেক কতটা অদরকারী,  উদয়ন চায় তাকে সসম্মানে নীচে নিয়ে যেতে। অথচ আজও সাহস করে আনন্দকে সত্যি কথাটা বলা হয় উঠল না।

2 comments:

Kajori Patra said...

Internet er oligoli dhore khujte khujte apnar blog'e eshe porlam. Shob kota bhishon bhalo lagche ar pore felchi lockdown er modhhei. Bhalo thakben.

Subrata Kundu said...

APNAR GOLPO GULI KHUB SUNDAR DADA, ADSENSE APPRUVAL NENNI KENO AMAKE REPLY DEBEN PLEASE AT KUNDU8299@GMAIL.COM