Skip to main content

মুকুলবাবু আর প্লেন হাইজ্যাক


২৯ সি। আইল সীট, তাই ঘনঘন বাথরুম-মুখো হওয়াটা অস্বস্তিকর ঠেকলেও মানুষজনকে ডিঙিয়ে টপকে অসুবিধেয় ফেলতে হচ্ছে না; সে'টা একটা বাঁচোয়া। প্লেন কলকাতা থেকে টেকঅফ করেছে প্রায় সোয়া ঘণ্টা হতে চলল; ইতিমধ্যে বার তিনেক উঠতে হয়েছে। নখ চিবিয়ে চিবিয়ে আঙুলের ডগাগুলোর অবস্থাও রীতিমতো বিশ্রী।  পাশের সীটে এক তরুণী বারবার আমার দিকে বাঁকা চোখে দেখছে। কপালে যে'ভাবে ঘাম জমছে আর অপর্যাপ্ত লেগ-স্পেসে যে ভাবে বারবার ছটফট করে চলেছি, মেয়েটির কুঁচকে যাওয়া ভুরু জোড়াকে কিছুতেই দোষ দেওয়া যায় না।

**

- একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না এজেন্টসাতাত্তরমশাই, হাইজ্যাকের প্ল্যানে আমি ঠিক কী ভাবে রয়েছি। আমায় বন্দুকটন্দুক কিছু দিচ্ছেন না। অবিশ্যি তুবড়িতেও আমার বুক কাঁপে, বন্দুকটন্দুক হাতে দিলেও কিছু করতে পারতাম না।

- মুকুলবাবু, আর কতবার বলব। আপনার কাজ শুধু ফ্লাইট নম্বর ইএল দু'শো বাইশে সময়মত বোর্ড করা। এ'টুকুর জন্যই আপনি এতগুলো টাকা পাচ্ছেন। এ'বার অকারণে মাথা ঘামানোটা বন্ধ করুন। হ্যাঁ, আপনার থেকে আমরা লুকোতে চাইনি যে আমাদের উদ্দেশ্য প্লেনটা হাইজ্যাক করা। তবে অপারেশনের ডিটেলস জেনে আপনার কোনো উপকার হবে না।

- কাজটা দেশ এবং সমাজবিরোধী। সে'টা আমি বুঝি এজেন্টসাতাত্তরদা। কিন্তু ছেলেটার অপারেশনের যা খরচ...বড্ড ফাঁপরে পড়েছি জানেন দাদা। মাস দেড়েক ধরে কোমায় পড়ে আছে অমন হিরের টুকরো ছেলে, আগামী বছর উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার কথা। ব্রাইট, মিশুকে, নম্র। নিজের ছেলে বলে বলছি না স্যর, বড্ড ভালো ছেলে ও। ওর অমন নির্জীব দেহ আর কাঁচের মত চোখ দেখে বুক ভেঙেচুরে যায়; বার বার। বিশ্বাস করুন! নয়তো এই বিশ্রী ব্যাপারে কিছুতেই জড়াতাম না..।

- আপনি বড্ড বাজে চিন্তা করেন মুকুলবাবু। বড্ড। পিলু সুস্থ হয়ে উঠবে, আমার অন্তত তেমনটাই মনে হয়।

- ও মা, আপনি দেখছি খোকার ডাকনামটাও জেনে বসে আছেন!   আপনার হোমওয়ার্কে তারিফ না করে উপায় নেই মশাই। আসলে কী জানেন, প্রসেসটা পুরো জানলে একটু কনফিডেন্স পেতাম। আপনাদের এত রাখঢাক, আরে আমার সঙ্গে লুকোচুরি করে লাভটা কী। আমি তো আপনারই টীমে। আমিও তো টেররিস্ট। আমার  সঙ্গে এত কথাবার্তা, এত দহরমমহরম; তবু এদ্দিনেও আপনার মুখ দেখতে পেলাম না। একবার ঝেড়ে কাশুন দেখি, আমি তো আপনারই দলে, নাকি?স্যাটাস্যাট সাধারণ মানুষকে কচুকাটা করার প্ল্যানে ঢুকে পড়েছি, তা বেশ বুঝছি। তবে নিজেকে সঁপে যখন দিয়েইছি, আমাকে নিয়ে আপনার ইয়ের কোনো মানেই হয় না।

- বেশি ভাবনাচিন্তায় কাজ গুবলেট হয়। সময়মত বোর্ড করবেন। বোর্ডিং প্ল্যান আর প্লেন নিয়ে কারুর সঙ্গে আলাপ জমাতে যাবেন না যেন; নিজের মিসেসের সঙ্গেও খেজুর করতে যাবেন না। হিতে বিপরীত হবে। কেষ্টপুরের যে স্পট আপনাকে বলা আছে; সে'খান থেকে আমাদের লোক আপনাকে তুলে নেবে আগামী সতেরো তারিখ। ঠিক সকাল সাড়ে আটটায়।

- আরে মনে আছে। আর কতবার বলবেন। অন্য টার্মিনাল থেকে এ প্লেন ছাড়বে কারণ প্রচুর ভিভিআইপি প্যাসেঞ্জার রয়েছে। আর আমার কাজ চুপচাপ আমার সীটে গিয়ে বসে যাওয়া। ২৯সি।  ইনস্ট্রাকশন আপনা থেকেই আমার কাছে চলে আসবে। আর সময়মত প্লেনটা হাইজ্যাক...।

- করেক্ট।

- শুধু একটাই রিকুয়েস্ট এজেন্টসাতাত্তরদা! একটু কনসিডার করে দেখুন। প্লীজ। ওই সতেরো তারিখই খোকার অপারেশন; ওই দিন এই অলক্ষুণে ব্যাপারটা না ঘটালেই নয়? সে'দিনটা অন্তত খোকার মায়ের পাশে থাকব না? আমি মানত করেছি যে; প্রাণ দিয়ে হলেও খোকাকে বাঁচানোর সমস্ত চেষ্টা আমি করব। আর আমি যদি সে'দিন হাসপাতালেই না থাকি...খোকার মা নিজেকে সামাল দেবে কী করে? প্লীজ..।

- এ'সব প্ল্যান অত মামুলি কারণে পালটানো যায়না মুকুলবাবু। পিলুর মঙ্গল চাইলে সতেরো তারিখ সকালে প্ল্যান মত কাজ করবেন। ফ্লাইট আর সীট নাম্বার খেয়াল থাকে যেন, কেমন? আপনার টিকিট আমার লোকের কাছেই থাকবে।

**

ঘড়িতে এখন সোয়া এগারোটা; ফ্লাইট দিল্লী পৌঁছনোর কথা দুপুর পৌনে একটায়। অবশ্য অদ্দূরের কথা ভাবার সময় এখন নয়। মনে মনে সাইমন স্নুটস হুইস্কার্স আউড়ে খানিকটা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম বটে; কিন্তু ভাঙা হাড়ের যন্ত্রণা কি আর হোমিওপ্যাথিতে কমে? প্রতিটা সেকেন্ড দুর্বিষহ মনে হচ্ছিল।

ঠিক এগারোটা বাইশ নাগাদ ঘটল গোলমেলে ব্যাপারটা। সিটবেল্ট বাঁধা না থাকলে নিশ্চিতভাবেই আমি ছিটকে পড়তাম সোজা প্লেনের মেঝেতে। প্লেনের পিএ সিস্টেমে যে কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল তা চিনতে আমার অসুবিধে হওয়ার কথাই নয়;
এজেন্টসাতাত্তরবাবু। অবাক কাণ্ড, এজেন্টসাতাত্তর আর আমার যে কথাবার্তাটুকু হল; তা'তে আশেপাশের কোনো যাত্রীই বিচলিত বোধ করলেন না; পাত্তাও দিলেন না।

- গুড মর্নিং মুকুলবাবু! নার্ভাস লাগছে? সীটে বসেই জবাব দিতে পারেন; আমি দিব্যি শুনতে পাব।
- সে কী মশাই, আপনি ইতিমধ্যে পাইলটকে ঘায়েল করে প্লেনটা হাতিয়ে নিয়েছেন?
- নাহ্, এ প্লেনের পাইলট আমিই।
- আপনিই? এ প্লেন আপনারই হাতে উড়ছে? তা'হলে হাইজ্যাকের ব্যাপারটা?
- হাইজ্যাকটা আপনার হাতে।
- কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আর হেঁয়ালি নেওয়া যাচ্ছেনা এজেন্টসাতাত্তরদা।
- খুলেই বলি। আমি কীসের এজেন্ট, তা ভেবে দেখেননি কোনোদিন?
- বিদেশী কোনো সংস্থার নিশ্চয়ই, তবে আপনার ক্যালকেশিয়ান বাংলার দরাজ প্রশংসা না করলে অন্যায় হয়।
- আমি এ দেশের নই। তবে কোনো দেশই আমার নয় মুকুলবাবু।
- কোনো দেশ..ইয়ে...আপনার নয়?
- আপনার চেনা কোনো দেশ আমার নয়। আমি এজেন্টসাতাত্তর, মৃত্যু উপত্যকার হয়ে আমার কাজ। কলকাতা শহর থেকে মড়াদের নিয়ে আমি এই এইএল দুশোবাইশ বা এক্সিট লাইফ দু'শো বাইশ ফ্লাইটে করে মৃত্যু উপত্যকায় দিয়ে আসি।
- দিল্লী যাওয়াটা ভাঁওতা? আমি মারা গেছি এজেন্টসাতাত্তরবাবু?
- আপনি দিব্যি জ্যান্ত একজন মানুষ মুকুলবাবু। কাজেই এ মড়াদের প্লেনে আপনাকে আনতে আপনাকে একটু ভাঁওতা দিতে হয়েছে।
- রেলের অফিসের ছাপোষা ক্লার্ক আমি। হিসেবের মাথামুণ্ডু কিছু বুঝছি না স্যার।
- এই প্লেনের ২৯সি বরাদ্দ ছিল পিলুর জন্য মুকুলবাবু!
- না! না!
- ওর অপারেশন এখন মধ্যগগনে। অপারেশন শেষে আমার ওকে নিয়ে কলকাতা ছাড়ার কথা। এ'দিকে সীট ফাঁকা রাখলে এ প্লেন ওড়ানো যায়না মুকুলবাবু। আপনার মানতের খবর আমি আগেই পেয়েছি। আপনি ভালোমানুষ, পিলুও আদর্শ ছেলে। আপনার মানত করা ঈশ্বর আছেন কিনা আমি জানিনা, কিন্তু আমি আপনাকে একটা সুযোগ দিতে চেয়েছি। এ ফ্লাইটে আপনাকে ভাঁওতা দিয়ে আনা হয়েছে; আপনি চাইলেই এ ফ্লাইট হাইজ্যাক করে কলকাতায় ফেরত নিয়ে যেতে পারেন। বন্দুকের দরকার আপনার নেই, আপনার ইচ্ছেই যথেষ্ট। আপনি বাঁচবেন,ফিরে যাবেন কলকাতায়। আপনাকে নামিয়ে এ প্লেন ফের উড়বে।
- কিন্তু ২৯সি'র সীটটা কিছুতেই খালি থাকবে না, তাই না এজেন্টসাতাত্তর?
- আপনি বুদ্ধিমান মুকুলবাবু। সমস্তই বুঝছেন। এ'বার বলুন,। হাইজ্যাক করবেন?
- এজেন্টদাদা গো। জানেন, পিলুর বয়স যখন আড়াই কি তিন; তখন ওকে ওর বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে বলত মুকু মুকুজি। মুকুল মুকুজ্জ্যে উচ্চারণ করতে পারত না। আপনি বরং আমায় এখন থেকে মুকুবাবু বলেই ডাকবেন এজেন্টসাতাত্তরদা। আর শুনুন মশায়, আপনাদের এয়ার হস্টেসরা বেশ ঢিমেতালে চলে দেখছি। দশ মিনিট আগে কফি চেয়েছি, তার এখনও পাত্তা নেই। একটু ফায়ার করুন দেখি; লম্বা ফ্লাইটে কফিটা টফিটা সময়মত না পেলে কি চলে?

Comments

Shantanik Basak said…
ei lekhata jatobaar pori tatobaar ekta advut jantronay bhore jaai.... samanyonek chhaposha manush... baba maar jonnyo kichu kore uthte na parar jantrona.... karon protibaar e anuvuti hoy je baba ma santaner jonnyo charom bolidan e pichhu haten na

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু