Skip to main content

মেঝে

নিশীথবাবু মেঝের দিকে তাকিয়েছিলেন। মোজায়েক মেঝে। পুরনো। জায়গায় জায়গায় যেন চলকা উঠে গিয়েছে। অমসৃণ বড়। বড় ধুলো পড়ে। এত মানুষ হাঁটাহাঁটি করেছে কিনা। সবাই আজ ঘরে চটি জুতো পরে ঢুকে পড়েছে। ধুলোর সাথে বোধ হয় অল্প কাদা। মেঝেটা বেশ নোংরা দেখাচ্ছে। 

নিশীথবাবু মেঝের দিকে তাকিয়েছিলেন। চোখের দৃষ্টিকে আশেপাশে খেলাতে মন চাইছিল না তার। মা তো নেই; যে এদিক ওদিক চাইলে মাকে দেখতে পাবেন। বড় লোক চারিদিকে। মা তো নেই। মায়ের গাওয়া হারমোনিয়ামে পল্লীগীতি তো আর নেই; সে তো কবেই চলে গিয়েছে। চারপাশের কলরবে কান পাততে মন চাইছিল না নিশীথবাবুর।

দৃষ্টির গোচরে মেঝের আবছায়া সাদা কালো মোজায়েক ছাড়াও এসে পড়ছিল নিশীথবাবুর জামার পকেট। জামাটা খয়েরী, এক রঙের, দু’বছর পুরনো। তার পাকা চুল আর শিথিল চামড়ার সাথে বেশ মানানসই; জামাটা। জামার পকেট থেকে উঁকি মারছে ডট পেন। নীল ঢাকনা, দশ টাকার রেনল্ড্‌স পেনের ঢাকনা। আর রয়েছে ভাঁজ করা সার্টিফিকেট; এই কিছুক্ষণ আগে পাওয়া। নিশীথবাবু আসলে মেঝের দিকে তাকিয়েছিলেন।

বলা ভালো, মেঝের এক কোণের দিকে তাকিয়েছিলেন। যে কোণে কোন ফুলের পাপড়ি এসে পড়েনি। সাদা ফুলের পাপড়ি এসে পড়েনি। চোখ সরাতে ভয় পাচ্ছিলেন নিশীথবাবু। পাছে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে মিশে যায় তুলির বডির সাথে। তুলি চলে যাচ্ছে। তুলি ওই মেঝেরই অন্য কোনে শুয়ে। ডেডবডি পড়ে থাকে, শুয়ে থাকে না। তুলি শুয়ে আছে। নিশীথবাবুর ভিতরের বাবাটা মরে গেল, অকালে। সাতাশ বছরের বাবা হয়ে থাকাটা মরে গেল। প্রভিডেন্ড ফান্ড, কোম্পানি লোণ, হাহাকার, যন্ত্রণা, ভালোবাসায় সন্তান মৃত্যু টলে না। নিশীথবাবুর আজ তুলির চেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছিল মায়ের জন্য। মা গো। মায়ে ডুব দিয়ে মরে যেতে পারলে কী ভালো হত। নিশীথবাবু শুকনো চোখে মেঝের দিকে তাকিয়েছিলেন। 

**
বাবা তাকাচ্ছিল না একবারের জন্যেও। এখুনি নিয়ে যাবে আমায়। এখুনি। বার বার তো মরা যায় না। না মরলে বুঝতে পারতাম না হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার পরেও মগজটা এমন সজাগ থাকে। কোন বইতে এমনটা লেখা ছিল না। থাকবে কী করে? কেউ কী মরে ফিরে এসেছে? জাতিস্মর হয়ে ফিরলে হবে না। এই আমি তুলি। আমি যদি মরে আবার তুলি হয়েই বেঁচে ফিরতাম তবে সবাইকে বলে দিতাম; মরে যাওয়ার পরেও মগজটা দিব্যি চলে। অন্তত গত আধ ঘণ্টা চলেছে। একটু আবছা হচ্ছে দৃষ্টি, কানের আওয়াজগুলোও। একটু পরে হয়তো সমস্ত মিলিয়ে যাবে। তবু। এটুকু সময়। আমি মরেও বেঁচে। কে যে চোখটা বুজিয়ে দিল অর্ধেক। তাই দেখতে অসুবিধে হচ্ছে। আমি কি না মরে গেছি, তাই চোখের পাতাটুকুও নাড়াতে পারছি না। তবে অর্ধেক চোখ খোলা এই বাঁচোয়া। বাবাটা যে কী! তখন থেকে শুধু মেঝের দিকে তাকিয়ে, একটি বারও আমার দিকে দেখছে না। 

আমার দিকে দেখ না বাবা প্লীজ! আমায় নিয়ে যাবে বাবা। দেখ না বাবা। ওদিকের মেঝেতে কিস্যু নেই। এদিকে আমি শুয়ে। আমি তোমার দেখতে পাব না আর বাবা। এদিকে দেখ না প্লীজ। প্লীজ। ভাগ্যিস আমার ঘাড়টা তোমার দিকেই, তাই তোমায় প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছি। এদিকে মা নেই, তাই দেখতে পাচ্ছি না। বাবা গো। বাবা গো। দেখ না বাবা। আমার দিকে। আমি ভূত না। কাদম্বিনী না। আমি মরেছি কিন্তু মরিনি। একটু পরে হয়তো পুরোটা মরে যাব। তার আগে আমার চোখে একটি বার চোখ রাখো। রাখো প্লীজ। 
যা:, কে যেন চোখে তুলসী দিলে। আর তোমায় দেখতে পারিনা বাবা। বাবা। বাবা। আবছা হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। কষ্ট হচ্ছে, শরীরে নয়, মনে। মনের শেষ কষ্ট।

বাবা গো। মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকো না। 


Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু