Wednesday, June 10, 2015

মেঝে

নিশীথবাবু মেঝের দিকে তাকিয়েছিলেন। মোজায়েক মেঝে। পুরনো। জায়গায় জায়গায় যেন চলকা উঠে গিয়েছে। অমসৃণ বড়। বড় ধুলো পড়ে। এত মানুষ হাঁটাহাঁটি করেছে কিনা। সবাই আজ ঘরে চটি জুতো পরে ঢুকে পড়েছে। ধুলোর সাথে বোধ হয় অল্প কাদা। মেঝেটা বেশ নোংরা দেখাচ্ছে। 

নিশীথবাবু মেঝের দিকে তাকিয়েছিলেন। চোখের দৃষ্টিকে আশেপাশে খেলাতে মন চাইছিল না তার। মা তো নেই; যে এদিক ওদিক চাইলে মাকে দেখতে পাবেন। বড় লোক চারিদিকে। মা তো নেই। মায়ের গাওয়া হারমোনিয়ামে পল্লীগীতি তো আর নেই; সে তো কবেই চলে গিয়েছে। চারপাশের কলরবে কান পাততে মন চাইছিল না নিশীথবাবুর।

দৃষ্টির গোচরে মেঝের আবছায়া সাদা কালো মোজায়েক ছাড়াও এসে পড়ছিল নিশীথবাবুর জামার পকেট। জামাটা খয়েরী, এক রঙের, দু’বছর পুরনো। তার পাকা চুল আর শিথিল চামড়ার সাথে বেশ মানানসই; জামাটা। জামার পকেট থেকে উঁকি মারছে ডট পেন। নীল ঢাকনা, দশ টাকার রেনল্ড্‌স পেনের ঢাকনা। আর রয়েছে ভাঁজ করা সার্টিফিকেট; এই কিছুক্ষণ আগে পাওয়া। নিশীথবাবু আসলে মেঝের দিকে তাকিয়েছিলেন।

বলা ভালো, মেঝের এক কোণের দিকে তাকিয়েছিলেন। যে কোণে কোন ফুলের পাপড়ি এসে পড়েনি। সাদা ফুলের পাপড়ি এসে পড়েনি। চোখ সরাতে ভয় পাচ্ছিলেন নিশীথবাবু। পাছে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে মিশে যায় তুলির বডির সাথে। তুলি চলে যাচ্ছে। তুলি ওই মেঝেরই অন্য কোনে শুয়ে। ডেডবডি পড়ে থাকে, শুয়ে থাকে না। তুলি শুয়ে আছে। নিশীথবাবুর ভিতরের বাবাটা মরে গেল, অকালে। সাতাশ বছরের বাবা হয়ে থাকাটা মরে গেল। প্রভিডেন্ড ফান্ড, কোম্পানি লোণ, হাহাকার, যন্ত্রণা, ভালোবাসায় সন্তান মৃত্যু টলে না। নিশীথবাবুর আজ তুলির চেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছিল মায়ের জন্য। মা গো। মায়ে ডুব দিয়ে মরে যেতে পারলে কী ভালো হত। নিশীথবাবু শুকনো চোখে মেঝের দিকে তাকিয়েছিলেন। 

**
বাবা তাকাচ্ছিল না একবারের জন্যেও। এখুনি নিয়ে যাবে আমায়। এখুনি। বার বার তো মরা যায় না। না মরলে বুঝতে পারতাম না হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার পরেও মগজটা এমন সজাগ থাকে। কোন বইতে এমনটা লেখা ছিল না। থাকবে কী করে? কেউ কী মরে ফিরে এসেছে? জাতিস্মর হয়ে ফিরলে হবে না। এই আমি তুলি। আমি যদি মরে আবার তুলি হয়েই বেঁচে ফিরতাম তবে সবাইকে বলে দিতাম; মরে যাওয়ার পরেও মগজটা দিব্যি চলে। অন্তত গত আধ ঘণ্টা চলেছে। একটু আবছা হচ্ছে দৃষ্টি, কানের আওয়াজগুলোও। একটু পরে হয়তো সমস্ত মিলিয়ে যাবে। তবু। এটুকু সময়। আমি মরেও বেঁচে। কে যে চোখটা বুজিয়ে দিল অর্ধেক। তাই দেখতে অসুবিধে হচ্ছে। আমি কি না মরে গেছি, তাই চোখের পাতাটুকুও নাড়াতে পারছি না। তবে অর্ধেক চোখ খোলা এই বাঁচোয়া। বাবাটা যে কী! তখন থেকে শুধু মেঝের দিকে তাকিয়ে, একটি বারও আমার দিকে দেখছে না। 

আমার দিকে দেখ না বাবা প্লীজ! আমায় নিয়ে যাবে বাবা। দেখ না বাবা। ওদিকের মেঝেতে কিস্যু নেই। এদিকে আমি শুয়ে। আমি তোমার দেখতে পাব না আর বাবা। এদিকে দেখ না প্লীজ। প্লীজ। ভাগ্যিস আমার ঘাড়টা তোমার দিকেই, তাই তোমায় প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছি। এদিকে মা নেই, তাই দেখতে পাচ্ছি না। বাবা গো। বাবা গো। দেখ না বাবা। আমার দিকে। আমি ভূত না। কাদম্বিনী না। আমি মরেছি কিন্তু মরিনি। একটু পরে হয়তো পুরোটা মরে যাব। তার আগে আমার চোখে একটি বার চোখ রাখো। রাখো প্লীজ। 
যা:, কে যেন চোখে তুলসী দিলে। আর তোমায় দেখতে পারিনা বাবা। বাবা। বাবা। আবছা হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। কষ্ট হচ্ছে, শরীরে নয়, মনে। মনের শেষ কষ্ট।

বাবা গো। মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকো না। 


No comments: