Skip to main content

ভীষ্ম

-   বিনোদবাবু ?

-   কে ? নির্মল নাকি ?

-   আজ্ঞে।

-   এসো। ভিতরে এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ? ভিতরে এসো।

-   সাড়ে আটটা বাজে বিনোদবাবু।

-   ও। তাইতো। আমার ব্যাপারটা কখন যেন ?

-   নটা বেজে বত্রিশ মিনিটে।

-   না না। দেরি হয়নি তাহলে। স্নান-টান সেরে রেডি হয়ে বসেছি।

-   না না। তাড়াহুড়ো নেই।

-   তা নেই। ছাদে কেমন ডালিয়া হয়েছে এবার দেখেছ তো ? দেখো। মাঝে মাঝে এসে দেখে যেও।

-   আজ্ঞে।

-   আর বাগানে ক্রিসেন্থিমাম লাগিয়েছিলাম, বিধু মালী কে বল যাতে ফাঁকি না দেয়। যত্নআত্তি করে।

-   আজ্ঞে

-   মিলু এসেছে ?

-   উনি গাড়িতে রয়েছেন।

-   বেচারাকে আজ অফিস কামাই করে কি ঝক্কিই না পোয়াতে হল। ভীষ্মর নাম শুনেছ বাবা নির্মল ?
-   আজ্ঞে ?

-   ভীষ্ম ? পিতামহ ? মহাভারত ?

-   আজ্ঞে আমি লেখাপড়া তেমন করলাম কই। চাকর বাকর মানুষ।

-   তা তোমার দোষ নয় নির্মল। আজকাল কটা লোকই বা মহাভারতের চর্চা করে। সে চর্চা ছিল আজ থেকে শ দুয়েক বছর আগে পর্যন্ত। রিলিজিয়াস এপিক নিয়ে আগ্রহ তখনও মানুষের ছিল। সে যাক। এই ভীষ্ম’র ইচ্ছামৃত্যু ঘটেছিল জানো?

-   আজ্ঞে ?

-   ইচ্ছামৃত্যু।

-   আজ্ঞে ?

-   মানে নিজের ইচ্ছেয় মৃত্যু ?

-   আজ্ঞে তাই তো হয়।

-   আহ। সে নয় এখন ঘটছে। কিন্তু এই শ দুয়েক বছর আগেও মানুষ নিজের ইচ্ছেয় মারা যেত না হে নির্মল।

-   নিজের ইচ্ছেয় মারা যেত না ? তবে ? মরতো কি ভাবে ?

-   রোগে। বার্ধক্যে। দুর্ঘটনায়।

-   কিসে কিসে কিসে?

-   ও। তাও তো জানো না। তখনও সঞ্জীবনী টিকা আবিষ্কার হয়নি।

-   মানে ওই ভি-ও-এল ? যা কিনা জন্মের পরেই আমাদের দেওয়া হয় ?

-   কারেক্ট। সে সময় এই ভ্যাক্সিন অফ লাইফ ছিল না। তাই মানুষের রোগ হত। বার্ধক্য আসতো শরীরে।

-   আজ্ঞে ?

-   মানে আমাদের এই শরীরটা কোনও না কোনও ভাবে ক্ষয়ে যেত।

-   আমাদের শরীরের ক্ষয় আছে নাকি বিনোদবাবু?

-   যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ে ছিল। আর নিখুঁত সামাজিক নিয়মানুবর্তিতা যেহেতু তখনও চালু হয় নি, দুর্ঘটনাও ঘটতো; তাতেও মানুষ মারা যেত।

-   দুর্ঘটনায় মৃত্যু ?

-   হ্যাঁ। যেমন বাসে চাপা পড়ে। অথবা এক মানুষ যখন ইচ্ছে করে তার সহনাগরিক কে হত্যা করতো ?

-   বাসে চাপা ? স্বেচ্ছায় হত্যা ? কোন অন্ধকার যুগ ছিল সে সময় বিনোদবাবু ?

-   অন্ধকারই বটে। অন্তত ইতিহাস তো তাই বলে। এখন না হয় যুগ পাল্টেছে। মৃত্যুর জন্যেও এখন আবেদন করতে হয় সরকারের কাছে। সরকার মৃত্যুর ক্যাপসুলে খাইয়ে শান্তিতে পার করে দেবে তবে মুক্তি নচেৎ নয়।

-   বিনোদবাবু। ছোটমুখে বড় কথা হয়ে যাবে। তবু বলি। আপনি আর দুটো দিন থাকতে পারতেন।

-   তা পারতাম। বেঁচে থাকার লোভ বড় কম তো নয়। কিন্তু ওই। মিলু বাবা হতে চাইছে। এ তো বিশ্ব-সরকারের অতি সহজ সুন্দর নিয়ম হে নির্মল; পরিবারে একজন নতুন কাউকে আনতে হলে অন্য একজন কে চলে যেতে হবেই। অপটিমাম পপুলেশন কে পাল্টাতে দেওয়া যাবে না।এর আগে মিলুর দাদা পিলু’র যখন ছেলে হল তখন পারমিতা চলে গেল। আমি তখনই ভলেন্টীয়ার করেছিলাম। সে শুনলে না সে কথা। বললে আমায় ছাড়া একা থাকতে পারবে না। এদিকে আমি যে একা একা এ কয় বছর কি ভাবে কাটালাম কি বলি। মিলু ফ্যামিলি প্ল্যানিং করবে বলে আমায় এক্সিট-রিকুয়েস্ট পাঠাতে আমি এক প্রকার হাফ ছেড়ে বেঁচেছি হে নির্মল।

-   আজ্ঞে।   

-   এ স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে জাপটে ধরা নেহাত সহজ নয় বোধ হয় নয় নির্মল। পিছুটান তো থাকেই। তবে আর দেরি নয়। সরকারী মৃত্যু-এজেন্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক নটা বত্রিশে। কি ? তাই তো বললে ?

-   আজ্ঞে।

-   চল চল। এগোই। কি জানো নির্মল। মাঝে মাঝে মনে হয় এ প্রযুক্তির ঠ্যালা বড্ড বাড়াবাড়ি। কয়েকশো বছর আগের ওই ভুলভ্রান্তি হঠাৎ-মৃত্যু-ওয়ালা জগতই বোধ হয় ভালো ছিল। অন্তত তখন কবিতা ছিল।

-   আজ্ঞে ? কবিতা ?

-   হ্যাঁ। কবিতা। সে যুগের ভ্যাক্সিন অফ লাইফ। হঠাৎ-মৃত্যু যতদিন ছিল ততদিন এ পৃথিবীতে কবিতা লেখা হয়েছে। যবে থেকে মৃত্যু আমাদের বাগে এসেছে, কবিতা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে হে নির্মল।   

Comments

Tobe amar mone hoy, byaparta QALY adjusted howa uchit. Quality Adjusted Life Years.

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু