Skip to main content

চেনা দু:খ - চেনা সুখ

উত্তর কোলকাতার এঁদো গলিপরিচিত বাঁকচায়ের দোকানপুরনো এসবেসটাস আর দরমায় বাঁধা ছোট্ট একটু দোকানমেসের গা-ঘেঁষাবছর কুড়ির এক মেদিনীপুরের যুবক ও তার পিতৃদেব কতৃক পরিচালিতযুবকের নাম অমিত, আমরাও বলতাম অমিতের চায়ের দোকানদোকানের আসবাব সর্বস্ব বলতে একটি উনুন, তিনটি বিস্কুটের বয়াম (লেড়ো, নোনতা ও মিষ্টি ধরন সমৃদ্ধ), কাঁচের এক গুচ্ছ চায়ের গেলাস, সসপ্যান-কেটলি সমৃদ্ধ সামান্য বসন-পত্র, এবং রাস্তার ধারে ফেলে রাখা একটা সরু বেঞ্চি। চা ছাড়াও সেখানে জুটতো ডিম-পাউরুটি এবং পাড়াতুতো আড্ডা-সমূহ।

ওই বেঞ্চিতে বসে চায়ের চুমুক ছিলো আমাদের মেসিও সান্ধ্য-প্রদীপ জ্বালানো। দোকান খোলা থাকতো রাত এগারোটা পর্যন্তঅতএব অসময়ে চুমুকও যে জুটতো না তা নয়এমনি এক শীতের রাত। মেসের গুমোট ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম চায়ের অজুহাতে। তখন রাত সাড়ে দশরাতের খাওয়া হয়ে গ্যাছে। অমিতের দোকান প্রায় খালি। বেঞ্চিতে একাই বসলাম। মাঝ-ডিসেম্বরের রাত্রি। গলিতে কোলকাতার ধোয়া-ধুলো মেশা কুয়াশা, সমস্তটা আবছা।গলির ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলো দৃষ্টি আরও গুলিয়ে দেয়। অমিতের বাবার গলার গামছাটা বছরের এই সময় মাফলার হয়ে ওঠে। উনুন ঘেঁষে বসে থাকে বাপ-ব্যাটা। ঘন-দুধ মেশানো বহু জাল খাওয়া চায়ের গেলাসে চুমুক দেওয়া মাত্রই , দোকানের রেডিও থেকে ভেসে আসা কবির সুমনের “চেনা দু:খ চেনা সুখ”। আগে বহুবার
শোনা গান। অথচ এমন হয়ে কখনো বুকে ঠ্যাকেনি। এত স্বাভাবিক, এত স্পষ্ট হয়ে ভেসে আসেনি সমস্ত কিছু। কোটি বছর ধরে যেন এই বেঞ্চিতে এসে বসছি, অমিত বাড়িয়ে দিয়েছে চায়ের গেলাস, কোলকাতা জড়িয়ে ধরেছে কুয়াশায়, সুমনের কণ্ঠস্বর এসে গলায় টেনিস বল গুজে দিয়ছে, কাঁচের গেলাস মাখা চায়ের গন্ধ চেপে দিয়েছে গলির স্যাতস্যাতে গন্ধ। আমার মাঝারি বেঁচে থাকাকে সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল অতিমানবিক।  গানটিকে মনে হয়েছিল নিজের, প্রচন্ড ভাবে নিজের। ওই আলো-আঁধারির কলকাতার গলির সঙ্গে জন্মান্তরের আত্মীয়তা আবিষ্কার করিয়েছিলো সেই মুহুর্তের গান

অকারণে কারা যে কান্না এনে দেননরম তুলতুলে পিয়ানোয় চেনা চেনা হাসি মুখের কথাচেনা মাটি চেনা পাড়া, চেনা পথে কড়া নাড়াএমন ভাবেও পরিচিতি নাড়িয়ে দিতে পারে? পেরেছিলো সেদিন; সেদিনের কোলকাতা ও সুমন। চেনা জটলা কে কী তীব্র নাটকীয় মনে হলো সেদিননিয়মিত রুটের বাসের শব্দকে মনে হলো আগুনেচেনা পথে দশ পা হেঁটে মেসে ফিরে যেতে সিরসিরিয়ে উঠলো গা। স্নেহ জমে উঠলো সমস্ত নিয়মিত আস্তরণ গুলো ঘিরে। মেসের দরজায় কড়া নাড়তেই মেস-বন্ধুর হাঁক রাত ছিড়ে দিলো, সেই মুহুর্তের স্বভাবিকতা হয়ে উঠলো কী ভীষণ ভাবে নায়কোচিত।

আজও একলা বসে যখন “চেনা দু:খ চেনা সুখ”য়ের সুর ভেসে আসে, পুরনো মেসবাড়ির গলির গন্ধ আর অমিতের চায়ের গেলসের উষ্ণতা ঝাপটা মেরে যায়।

Comments

Suhel Banerjee said…
I cannot emphasize enough how extraordinary your writing is and how much more mature it's becoming with every post. I'm yet to come across any other writer/author/blogger who describes every day Bengali life and emotions better. And that includes every published author I've read.

Just wish you also had the transliterated version of your posts.
Rezwan said…
অসাধারণ
Aniruddha Sen said…
এটাই তোমার জগৎ: স্মৃতিচারণের গদ্য, রসরচনার গদ্য, কথোপকথনের গদ্য৷ সুমন যখন কবির হয়নি, রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের করেছিল একটা, মিনিমিনি বাসবাসে চড়তে তখনও ঢের দেরি, তখন থেকে তক্কেতক্কে ছিলাম আমি৷ ওর নতুন গান প্রথম শুনি দিল্লি রোড ধরে কোলকাতা যাওয়ার পথে, ডানকুনির জোড়া-ঢাবায় চা খেতে দাঁড়ানো অন্য একটা গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে৷ ঘুরপথে চন্দননগর থেকে সদ্য শোনা ক্যাসেট কিনে শুনতে শুনতে বাড়ি ফিরি৷ আজও মনে আছে সে দিনটা: সলিল চৌধুরির পর 'মহিনের ঘোড়াগুলি'র গৌতম (আলাপ ছিল তার সঙ্গে, তাই তার জীবদ্দশায় মূল্যায়ন করতে পারিনি হয়ত!), তারপর সুমন৷ তোমার স্মৃতিকথা ভালো লাগলো৷
Dear diary said…
অনেকবার পড়লাম । এই ভাবেই আমরা হয়ত Blog কে বই এর আকারে পাব , এই আশা ই রাখলাম তবে.....
Dear diary said…
Spellbound !! Keep it up :))

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু