Skip to main content

দিবাকর মুন্সীর ফর্মুলা


*
ব্যাপারটা তেমন কঠিন নয়৷ হোমিওপ্যাথির চারটে বড়ি এক  গেলাস জলে মিশিয়ে দেওয়া। ব্যাস, কাজ শেষ। কাচের গেলাসটা শৌখিন কাঠের টেবিলের ওপর রাখা থাকবে, সকালের দিকটায় এ' ঘরে কেউ থাকবেও না। গেলাসের জলে সে বড়ি মিশিয়েই মনোহরের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার কথা। ঘরটা আদতে স্বনামধন্য লেখক অমল চৌধুরীর অফিসঘর। মনোহর বেরিয়ে যাওয়ার আধঘণ্টা পর অমলবাবু  সেই ঘরে ঢুকবেন, নিজের টেবিলে বসবেন আর কিছুক্ষণের মাথায় নিশ্চয়ই সেই গেলাসে চুমুক দেবেন৷ 

সেক্রেটারি হিসেবে কাজটা করতে একদমই মন সরছিল না মনোহরের। কিন্তু এই সামান্য কাজের জন্য দিবাকর মুন্সীর আড়াই লাখটাকার অফারটা ফিরিয়ে দেওয়া গেলনা। অমল চৌধুরীর সেক্রেটারি হিসেবে দেড় বছর চাকরী করেও এত টাকা আয় করতে পারেনি সে। দিবাকর মুন্সী প্রকাশক, অমলবাবুর বেশির ভাগ বই উনিই ছাপেন। সম্প্রতি কী একটা ব্যাপার নিয়ে দু'জনের মধ্যে মন কষাকষি শুরু হয়েছিল বটে। কিন্তু দিবাকরবাবু যে আড়ালে ডেকে এমন একটা অফার দিয়ে বসবেন, সে'টা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি মনোহর।

অবশ্য অমলবাবু মানুষ হিসেবে তেমন সুবিধের নন, পয়সাকড়ির ব্যাপারে বেশ চশমখোরই বলা চলে। কিন্তু তবু এমন গোলমেলে একটা কাজ করতে যে সে রাজী হবে সে'টা মনোহর আগে ভাবেনি। নিজের মধ্যে যে এত লোভ জমে আছে, সে'টা সে এর আগে টের পায়নি। দিবাকর মুন্সী অবশ্য বারবার আশ্বাস দিয়েছে যে অমল চৌধুরীকে প্রাণে মারবার কোনও ইচ্ছে তার নেই। তাছাড়া এই অমলবাবুর সেক্রেটারির চাকরীটাও দিবাকর মুন্সীই পাইয়ে দিয়েছিলেন।  তাছাড়া দিবাকরবাবু ঘোর ব্যবসায়ী মানুষ, তাঁর কথায় বিশ্বাস করারও কোনও কারণ নেই৷ তবে আগাম হাতে পাওয়া আড়াই লাখটাকার জন্য এ সামান্য কাজটুকু না করার মানে হয়।


**

- হ্যালো।

- হ্যালো। দিবাকর? নাহ্ হে। ক'দিন ধরে অনেক ঝগড়াঝাটি করলাম বটে তোমার সঙ্গে। কিন্তু আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে তোমার কথাই ঠিক৷ আমি আর প্রেমের গল্প লিখব না। বড্ড বেশি রিপিটেটিভ হয়ে যাচ্ছিল। এ'বারে পুজোয় আমি বরং একটা ভৌতিক উপন্যাস জমা দেব। প্রেমের দু'টো লেখা পড়েছিল। নিজেই সে লেখায় চোখ বুলিয়ে দেখে বুঝলাম; সেই একঘেয়ে বিরক্তিকর খাড়া বড়ি থোড। ফর্মুলায় পেয়ে বসলে যা হয় আর কী। কিন্তু আমার ঘোর কেটেছে৷ পাণ্ডুলিপি দু'টো পুড়িয়ে ফেলেছি। ভূতের উপন্যাসের একটা প্লটও মাথায় দানা বেঁধেছে। আজই লেখা শুরু করব।

- অমলদা, যখনই আপনি নতুন স্টাইল ধরেছেন, ফাটিয়ে দিয়েছেন। এ'বারেও তাই হবে। আমি নিশ্চিত।

- কিন্তু তোমার একটা সাহায্য লাগবে যে দিবাকর।

- এনিথিং ফর ইউ অমলদা। বলুন না।

- কোনও সেক্রেটারিই আমার অফিসে বছর দেড়েকের বেশি টিকছে না হে। আর সেক্রেটারি ছাড়া যে আমি অচল।

- সে কী, ওই যে ছেলেটি। কী নাম যেন.. মনোহর। বেশ চটপটে করিৎকর্মা ছোকরা বলে মনে হয়েছিল তো। সেও কেটে পড়েছে নাকি?

- এই নিয়ে টানা সাত নম্বর সেক্রেটারি না বলে কয়ে ডুব দিল হে। স্ট্রেঞ্জ ব্যাপারস্যাপার।  আর তুমি ছাড়া তো আমার গতি নেই। দাও দেখি একটা নতুন কাউকে খুঁজেপেতে।  

- ও নিয়ে আপনি ভাববেন না অমলদা। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

***

- এসো দিবাকর। এসো। 

- কেমন আছ ডাক্তার?

- যেমন দেখছ৷ দিব্যি।

- তোমার জন্য নিয়ে এলাম। এই দ্যাখো।

- নতুন পাণ্ডুলিপি? 

- অমল চৌধুরীর নতুন নভেল। পুজোর আগেই ছেপে বেরোবে। এই প্রথম ভদ্রলোল ভৌতিক প্লট নিয়ে লিখল। পড়ে দ্যাখো ডাক্তার, এক্কেবারে হাইক্লাস। কে বলবে কয়েকমাস আগেই গেঁজে যাওয়া প্রেমের প্লটে দিস্তে দিস্তে লিখে পাঠকের হাড় জ্বালাচ্ছিল। 

- বেশ পড়ে দেখব। তবে সেই তো ভিশিয়াস সাইকেল। এই ভূতের নভেল বেস্টসেলার হবে। তারপর একটানা যাই লিখবে শুধু ভূত। ততক্ষণ লিখে যাবে যতক্ষণ না পাঠক বমি করতে শুরু করেছে৷ 

- তা আর বলতে। গোয়েন্দা গল্প পাঠক খেলো মানে একটানা শুধু ডিটেকটিভ নভেল চালাবে। ঐতিহাসিক শুরু হলো তো বছরখানেক শুধু ঐতিহাসিক।  একবার প্রেমের প্লটে আটকা পড়ল তো শুধু গদগদ। আবার নামী লেখকের ইগোর ওজনও কম নয়৷ বিন্দুমাত্র নেগেটিভ ফীডব্যাক পেলেই বাবুর গোঁসা হয়ে যায়। 

- ফর্মুলা যে সাহিত্যের কী ক্ষতি করে। অথচ ফর্মুলা ফর্মুলা করেই অমলবাবুরা নষ্ট হয়ে যান, আর পাঠকদের প্রতিও অবিচার করেন।

- অগত্যা। ফর্মুলা ভাঙার দায় নিতে হয় আমার মত প্রকাশকদের৷ নেহাত তোমার ওই সাহিত্য ফর্মুলা ভাঙার জাদুবড়ি ছিল ডাক্তার। ওটির গুণেই তো বারবার এই অমল চৌধুরীকে খাদের ধার থেকে টেনে আনতে পারি। তবে যাদের দিয়ে অমলদাকে এ বড়ি গেলানো, সেই সেক্রেটারিগুলোর খাই বড় বেড়ে গেছে আজকাল।

- স্টাইলভাঙা লেখকের বই বেচে মুনাফাও তো কম হয়না তোমার দিবাকর। না হয় মাঝেমধ্যে অভাবী ছেলেমেয়েগুলোকে কিছু কিছু দিলে। যাকগে, শোনো। অমল চৌধুরী আগামী কিছুদিন ভূতের গল্প নিয়েই থাক। পরের বছর ওর স্টাইল ভাঙার জন্য নতুন বড়ি তৈরি করছি, এ'বার ওঁর ভাঁড়ার থেকে রম্যরচনা টেনে বের করব ভাবছি। 

- ব্রাভো ডাক্তার। ব্রাভো। এমনিতে অমলদার ভাষার জোর আছে৷ শুধু তোমার ওই স্টাইলভাঙার সাহস দেওয়া বড়ির সাপ্লাই থাকলেই, ভদ্রলোক অসাধ্যসাধন করতে পারবেন। 

-  আমার কমিশনটা ভুলো না যেন দিবাকর। 

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু