Skip to main content

সৈনিক ও পোস্টমাস্টার



চারিদিকে বিস্তর গোলাগুলি,  বোমারু বিমান দমাদম তাল ঠুকে যাচ্ছিল শহর জুড়ে। মাঝেমধ্যেই হাড়-হিম করা সব চিৎকার। বেশির ভাগই আর্তনাদ; ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা আর বিলাপ। এ'ছাড়া কিছু আস্ফালনও বাতাসে বারুদের গন্ধের সঙ্গে ঘুরঘুর করছিল;
"দুশমনের মুণ্ডু চাই, হারামজাদাদের রক্ত চাই"। 

এত সব কিছু মাঝে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত এই আধ চেনা শহরের ঠিক মধ্যিখানে একটা ভাঙাচোরা প্রাসাদের এক কোণে বসে চিঠি লিখছিলেন কম্যান্ডার নেদু। 

ডিয়ার গিন্নী, 

খতরনাক যুদ্ধ চলছে। এ পক্ষ ইট ছুঁড়ছে তো অপর পক্ষ সোজা পাটকেল তাক করছে খুলিতে। রে রে রে রে ব্যাপার। 

খানিক আগেই মড়মড় করে পাশের বাড়িটা ধ্বসে পড়ল। ও'টা হাসপাতাল ছিল এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত। কিছুদিন ধরে অবিশ্যি বাড়িটা বেওয়ারিশ পড়েছিল। মড়াদের হাসপাতাল না গেলেও চলে। এই আমি যে'খানে বসে এখন তোমায় চিঠি লিখছি; সে'টা কিছুদিন আগেও লাইব্রেরি ছিল। আমি শিশু সাহিত্যের শেলফের সামনে একটা টুল টেনে বসেছি। বইঠই বেশির ভাগই জ্বলে ছাই, শেলফের মাথায় টাঙানো বিভাগের নামগুলো রয়ে গেছে কোনও ক্রমে।  সেই একই কথা, মড়াদের দেশে লাইব্রেরি রাখা মানে সিগারেটকে চাটনিতে ডুবিয়ে খাওয়া। 

যা হোক, যে কথা বলতে তোমায় চিঠি লেখা। এই চিঠি হাতে পেয়ে একটা গান গাইবে? প্লীজ? মেঘলা দুপুরে কামিনী ফুলের সুবাসের মত সুর খেলে বেড়াবে হাওয়ায়। গাইবে? প্লীজ?

ওই। গোলাগুলির শব্দ এগিয়ে আসছে। এখন চিঠি পোস্ট না করলেই নয়। 

ইতি 
শ্রী শ্রী হাসব্যান্ডবিহারী নেদুগুপ্ত। 

মোটা কাগজের খয়েরী খামে যত্ন করে ঠিকানা লিখলেন নেদু কম্যান্ডার ( আহা, নিজের বাড়ির ঠিকানা লেখা খামের দিকে তাকিয়ে থাকলেও বুকে আরাম লাগে। আহা)।

পোস্টবাক্স হাতের কাছেই ছিল। বুকপকেটের ডাকবাক্সে চিঠি ফেললেন কম্যান্ডার নেদু। 

***

ফুরফুরিয়ে উড়ছিলেন নেদুকুমার! বাতাসে বারুদের সুবাস বিলকুল হাপিশ। মেঘলা আকাশ, ভেজা ভেজা হাওয়া আর তা'তে কামিনী ফুলের আনচান করা সুবাস।  

নেদুগুপ্তের টের পেতে সময় লাগলনো যে আর তিনি কম্যান্ডার নন। মিনিট খানেক হল তার চাকরী পাল্টেছে। 

চারদিকে বড় ভালো লাগা। পোস্টম্যান নেদু গুপ্ত বুঝলেন পোস্টবাক্স ক্লীয়ারেন্সের সময় এসেছে। নেদু বুকপকেটের পোস্ট বাক্স খুলে উঁকি মারলেন; একটাই চিঠি। 
আহা, সে চিঠিতে বুলেটের ছোপ! 
আহাম্মকের দল! যাক গে,চিঠি সামান্য ঝলসেছে বটে, তবে পড়তে অসুবিধে হয় না। 

***

- মিসেস গিন্নীগুপ্ত বাড়ি আছেন?
- কে? পোস্টমাস্টার নাকি?
- তবে আর বলছি কী! চিঠি আছে!
- কার চিঠি?
- বর গুপ্তের! 
- ও মা! তুমি! আচ্ছা মানুষ তো! অমন দুম করে কেউ ঘরবাড়ি ছেড়ে যুদ্ধে যায়? 
- যাহ্‌! তুমি কম খালিফা নও! অমন দুম করে কেউ দু'দিনে জ্বরে সরে পড়ে? 
- সরে না পড়লে চিঠি দিতে আসতে কাকে? 

"খিক খিক" শব্দের বিশ্রী হাসিতে গড়িয়ে পড়তে ভালোবাসেন পোস্টমাস্টার নেদুগুপ্ত। 
মেঘলা দুপুরে কামিনী ফুলের সুবাসের মত গীন্নিগুপ্তের সুর খেলছিল হাওয়ায়।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু