Skip to main content

অঙ্কের ছ্যাঁত, ছ্যাঁতের অঙ্ক



১। 

মান্তুদা জবাব দিয়ে দিয়েছে। ফাইনালে অঙ্ক পরীক্ষায় ভদ্রস্থ নম্বরের আশা প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু যদি কোনও ক্রমে পাশটা করা যায়। কোনও ক্রমে চল্লিশ।

বেশ কিছুদিন ধরে দীপুকে মান্তুদা একা পড়াচ্ছেন। মান্তুদার মতে দীপুর অঙ্ক-ভয়কে ম্যান টু ম্যান মার্কিং না করলে ক্যালামিটি এড়ানো অসম্ভব। গত তিন মাস ধরে প্রতিদিন রাত্রে মান্তুদার বারান্দায় এসে পড়ে থেকেছে দীপু। প্রবাবিলিটি পারমুটেশন অমুক তমুক পড়ানো শেষ হলে মান্তুদা নিজের পকেট রেডিওতে গান শোনাতেন। সাত-পুরনো হিন্দী গান। রোজ।  

"তোর মনে টার্বুলেন্স চলছে। এতগুলো কনসেপ্ট একসঙ্গে মাথায় ঘুরপাক খেয়ে ঘোল পাকাচ্ছে। সেডিমেন্ট জমতে না দিলে মুশকিল। মিউজিক কে ইউটিলাইজ করতে শেখ। নোটেশনেও অঙ্ক থাকে, সে খবর রাখিস তো"? 

ডিসেম্বরের রাত বারান্দাকে জাপটে ধরত। দীপুর হাফ সোয়েটার ছাপিয়ে গা শিরশির।  মান্তুদার টেবিলে তাল দেওয়া। দীপুর বুকে " আর হল না" গোছের ছ্যাঁত ছ্যাঁত। 

বারান্দা পেরিয়ে মান্তুদার বাবার নিজের হাতে চাষ করা গোলাপ বাগান। সে বাগানের ও'পাশে গোলাপের সুবাসকে জুতোপেটা করা সারের ঢিপি। তার ও'পাশে সরু গলি। গলির ও'পাশে নীল রঙের দোতলা বাড়ি। 

সেই দোতলার ব্যালকনিতে আবছায়ার সঙ্গে মিশে যেত মান্তুদার রেডিওর "রাহ্‌ হে পড়ে হ্যায় হম কব সে আপ কি কসম, দেখিয়ে তো কম সে কম, বোলিয়ে না বোলিয়ে, হম হ্যায় রাহি পেয়ার কে হম সে কুছ না বোলিয়ে"। 

আবছায়ায় গান আর বাতাসের গুঁড়ো গুঁড়ো শীত মিলে মিশে সে বারান্দায় তৈরি হত নীল রঙের শালের পায়চারি। নীল শাল জানে রাস্তার ও'দিকের বারান্দায় অঙ্ক কাহিল কলজের থেবড়ে বসে থাকা। নীল শাল অঙ্কে তুখোড়, মায়ায় নিখুঁত। 

বুকের ছ্যাঁত নরম হয়ে আসত। দুপুরের জমানো রোদ আর অল্প ন্যাপথালিন মেশানো লেপের সুবাস, ঠাকুমার ছ্যাঁচা পানের স্বাদ আর মায়ের হাতে মাখা আলুসেদ্ধ; সমস্ত মিলে মনের অসোয়াস্তি কমে আসত। দীপুর বুকের ভিতরের যাবতীয় "হল না" ভাব উবে যেত।  
ব্যালকনির গুনগুন আর রেডিওর মিনমিন বাতাসে মিশে অন্য ছ্যাঁত তৈরি হত 
"দিল পে আসরা কিয়ে, হম তো বস ইউ হি জিয়ে, 
এক কদম পে হস লিয়ে, এক কদম পে রোল লিয়ে"।  


২।

"দীপক, ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া এই কোয়ার্টারের মার্কেট শেয়ার কতটা নেমেছে"?

"ইয়েস স্যর? আমায় কিছু বললেন"?

"হোয়াটস রং উইথ ইউ? তোমার মার্কেট শেয়ার প্লাঞ্জ করছে আর তুমি ক্লুলেস হয়ে বসে রয়েছ"? 

দীপকের কানে বুকে দমাদম আছাড় খেতে থাকে উৎকট সব অর্থহীন শব্দ; মার্কেটশেয়ার, রেস্পন্সিবিলিটি, টার্গেটস, ফোকাস...আরও কত কী। শহরের ঠুঁটো ডিসেম্বরে মান্তুদার রেডিও খাপ খেত না কিছুতেই। বুকে ছ্যাঁত জমতে শুরু করে, স্পষ্ট টের পায় দীপক।  

ছ্যাঁতছ্যাঁতের মেঘ ক্রমশ ডাগর হয়ে বুক ভারি করে ফেলে। দীপুর আঙুলগুলো তিরতির করে কাঁপতে থাকে। নোটেশনেও অঙ্ক থাকে।  মান্তুদার ফতুয়ার পকেট থেকে বেরোনো নীল কালো রেডিওটার কথা মনে পড়ে দীপুর। বারান্দার ও'পাশে গোলাপ বাগান, তার ও'পাশে রাস্তা, রাস্তার ও'দিকে দোতলা বাড়ি। ব্যালকনি। 

"দর্দ ভি হমে কবুল, চ্যেন ভি হমে কবুল 
হমনে হর তরহ কে ফুল হার মে পিরো লিয়ে"। 

দীপু বুকের মধ্যে অঙ্ক পরীক্ষা মার্কা "হল না"র জাপ্টে ধরা টের পায়। "আর হল না"গুলো  আর উবে যেতে পারে না। 

নীল শালের "বাবু দেখিস, সব ঠিক হয়ে যাবে" মার্কা অপ্রয়োজনীয় স্প্যাম এসএমএস ডিলিটি করে, মার্কেট শেয়ারের জরুরী স্প্রেডশিটে চোখ রাখেন দীপক চ্যাটার্জী।  ইয়ারফোনে ছ্যাঁত-রেগুলেটর:

"ধুপ থি নসীব মে, ধুপ মে লিয়া হ্যায় দম, 
চাঁদনী মিলি তো হম, চাঁদনী মে সো লিয়ে"।  

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু