এ যে সামান্য Déjà vu নয় তা বনোয়ারী বেশ টের পাচ্ছিলেন।
মুঙ্গেরে এর আগে তিনি বাপের জন্মে আসেননি। নেহাত অফিসের কাজে ছুটে আসতে হল। বিকেলের
দিকে তেমন কোনও কাজ না থাকায় মুঙ্গের অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্লার্ক দীননাথ-বাবুর
সাইকেল ধার করে একটু শহরতলি ঘুরতে বেরিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু শহর-প্রান্তে এই ডোবা ঘেঁষা সবুজ তিন কোনা মাঠটুকুর পাশে এসেই এক
ভুতুড়ে টানে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন বনোয়ারী। গঙ্গার ফুরফুরে নভেম্বরের হাওয়া সত্ত্বেও কেমন
গরম লাগছিল তাঁর; বুকে চিনচিন। গত সেপ্টেম্বরে সাতচল্লিশে পড়েছেন, কিন্তু ব্লাড
প্রেশার বা হার্ট-ঘটিত কোনও অসোয়াস্তি তাঁকে কখনও পোয়াতে হয়নি – তিনি বুঝতে
পারছিলেন যে এই বুকে চিনচিন-ভাবটা অস্বাভাবিক। ঘামে শার্ট ভিজে গেছে তাও বেশ টের
পাচ্ছিলেন বনোয়ারী। সাইকেল স্ট্যান্ড ফেলে দাঁড় করবেন সে শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে
ফেলেছেন; কোনও রকমে সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়ালেন আর সাইকেলটা শিথিল হয়ে লুটিয়ে পড়লো।
কিন্তু এই শারীরিক অস্বস্তি মাঝেই বনোয়ারী টের পাচ্ছিলেন তাঁর মনের ভিতর এক
ভালো-লাগার তোলপাড় চলছে। ওই গঙ্গার ছপছপ শব্দ, ওই নরম মাটি, এই দেহাতি ঘাসের গোবর
মাখা গন্ধ; ভীষণ আপনার মনে হচ্ছে। অদূরে দুখানা গরু ঘাস থেকে মুখ তুলে টলটলে চোখে
বনোয়ারীর দিকে তাকালে।
এখানে মাটি ভেজা। পায়ের পাম্প শু’টা চট করে খুলে ফেললেন বনোয়ারী; খালি পা ঘাসে
রাখতে যেন প্রাণ আঁকুপাঁকু করছিল তাঁর। এ তাঁর বহু চেনা। বহু চেনা। এ জায়গা নব্বই
বছরেও এক চুল পাল্টায়নি।
বনোয়ারী শরীর জুড়ে এলো থরথর কাঁপুনি। ওই যে এক প্রান্তের পাথুরে ঢিপিটা। এত
বছরেও ঢিপির পাশের সেই প্রমাণ সাইজের বিশ্রী আবর্জনা ভর্তি গর্তটা বুজে যায়নি;
সেখানে একবার পা হড়কে পড়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। সে কবেকার কথা! এখানে আশেপাশের সমস্তটাই
নিখুঁত ভাবে চেনা তাঁর। তিনে ছিলেন। এখানেই। এখানেই।
গা গুলোতে শুরু করেছিল; বনোয়ারীর মনকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করলেন। ভাবতে
চেষ্টা করলেন যে দুপুরবেলা চাপাটি-সবজির লাঞ্চ তিনি মোটেও জুত করে খেতে পারেননি
এবং শিগগিরি কিছু খাওয়ার দরকার। কিন্তু মন পর মুহূর্তেই ফের চঞ্চল হয়ে উঠলেন।
অস্থির হয়ে ঘাসের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন বনোয়ারী।
তাঁর কলকাতার সওদাগরী অফিসের চাকরি, বারাসাতের এক চিলতে বাসা, এই মুঙ্গেরে
অফিস-ট্যুর; সমস্তই আবছা হয়ে আসছিল। নিজের গলা বেয়ে কেমন একটা দলা পাকানো গোঙানি
উঠে আসছে বলে মনে হল বনোয়ারীর। তিনি এইখানে ছিলেন, তিনি নিশ্চিত। এ মাঠে তিনি
দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন। নিশ্চিত। এ সব সিনেমা-কথা বা ভাঁওতা নয়;
এ জিনিষ আছে, এ ব্যাপার ঘটে। আহ:, সন্ধ্যে নেমে আসছে, কিন্তু বনোয়ারীর মন আবছায়াতে
আছে – তাঁর হুঁশ প্রায় নেই। তাঁর মনে হাজার হাজার দৃশ্য গলগল করে বয়ে আসছে। কিন্তু
সে সব কোনও দৃশ্যই তাঁর এ জীবনের সাথে আদৌ যুক্ত নয়।
কাটা পাঁঠার মত ছটফট করছিলেন বনোয়ারী; ঠিক যন্ত্রণায় নয় – একটা অদ্ভুত
চিড়বিড়ানি সমস্ত শরীর জুড়ে। মাথার ওপরে আকাশটা চ্যাপ্টা হয়ে নেমে আসছে যেন। আহ:,
কতদিন আগেকার বেঁচে থাকা কেমন জবরদস্ত ভাবে থাকে আবার এসে জাপটে ধরছে।
আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। হাম্বা ডাক ছেড়ে নরম ঘাসে দাঁত বসালেন বনোয়ারী।
Comments
mithu