বিনু মারান্ডিরবাড়িতে সন্ধ্যেটা মন্দ কাটলে না। ছোট্ট কুঁড়ে, তার উঠোনে খড়ের ওপরে পাতা মাদুর ;
এই হলো বিছানা। খান-কুড়ি আদিবাসীদের গেরস্থালি মিলে এই গ্রাম। আদিবাসীদের উচ্চারনে
ঠিক মালুম হয় না; তবে গ্রামের নাম বোধ হয় বিধ্মা। বিটকেল। বিধ্মা’র কাছেই রয়েছে
ঝাড়খণ্ডের জঙ্গল। সব চেয়ে কাছের বসতি রয়েছে রামগড়ে; অন্তত আড়াইশো মাইল দূরে।
যাচ্ছিলাম রামগড়েই। ঠিক সন্ধ্যের মুখে গাড়িটা গড়বড় করলে এই খানে এসে। নিজের
বিদ্যেয় অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু গাড়ি গুমরে রইলে। পুরনো ফিয়াট গাড়িটা এবার বিদায় করতে হবে; এত দুরের ড্রাইভে
এমন নড়বড়ে গাড়ি নিয়ে বেরোনোটাই ঝুঁকি। আশেপাশে মেকানিকের টিকিও নেই। রামগড়ে এক
সহকর্মী থাকে; মোবাইলে অগত্যা তাকেই ধরতে হলো। সহকর্মীটি জানালে সে গাড়ি এবং
মেকানিক দুইই পাঠাচ্ছে তবে তা ভোরের আগে পৌছবে না।
অগত্যা কাছের এই
আদিবাসি বসতি দেখে এখানেই ঢুঁ মেরে দেখলাম রাতে মাথা গোঁজার একটা ব্যাবস্থা করতে
পারি কি না। বিনু মারান্ডির এই
কুঁড়েতে আশ্রয় জুটে গেল; বিনুই এ গ্রামে এক মাত্র স্মার্ট ব্যাক্তি; মোড়ল গোছের
কিছু বোধ হয়, ভাঙ্গাচোরা হিন্দিতে চমৎকার কাজ চালিয়ে নিতে পারে। আশ্রয় দিতে রাজি
হওয়ায় একটা একশো টাকার নোট অফার করেছিলাম; তখনই টের পেলাম যে বিনু সভ্য কায়দায় জিভ
কাটতেও দিব্যি শিখে গেছে।
বিনুর বউ’য়ের
হাতের রান্না শহুরে জিভে রুচবেনা, সেটাই স্বাভাবিক। হরলিক্স বিস্কুট আর বিসলারির একটা জলের বোতল সঙ্গে থাকায়
রাতের খাওয়ার চাপ কমে গেছিলো। অগস্ট মাসের রাত; ভ্যাঁপসা গরমটা নেই; মন্দ লাগছিলো
না উঠোনে গা এলিয়ে শুয়ে থাকতে।
লক্ষ্য করলাম
বিনুর কুঁড়েতে বেশ কিছু প্রতিবেশী এসে জড়ো হয়েছে। সবার হাতেই ছোট ছোট মাটির হাঁড়ি
; আর সেই মাটির হাঁড়িতে যে তুলসি ভেজানো জল নেই তা স্পষ্ট। বাতাস ভারি করা গন্ধটা
নাকে জমা হতেই নিশ্চিন্ত হলাম; আসলি হাঁড়িয়ার সুবাস তাহলে একেই বলে। অস্বস্তির ব্যাপার হল সবাই দাওয়ায় বসে আমায় হাঁ
করে দেখে চলেছে; বুঝলাম শহুরে পাবলিক এ সব দিকে বড় একটা ঘেঁষে না। নিজেকে ইয়েতি
মনে হচ্ছিলো আশেপাশের এমন বাড়াবাড়ি কৌতূহলে।
হাত ঘড়িতে দেখলাম
রাত আট’টা। ভোর চারটের আগে মেকানিক বা গাড়ি এসে পৌঁছোবার কোনও সুযোগ নেই। একটু চোখ
বুজে ঘুমের চেষ্টা করবার তাল করছি এমন সময় বিনু মারান্ডি কাছে এসে বসলে। বুঝলাম
এবার সামান্য আলাপ না করলে ভালো দেখায় না।
হিন্দিতে জিজ্ঞেস
করলাম “বিনু, তোমরা কর কি ? পেট চলে কিভাবে ?”
বিনু বললে – “
জঙ্গল ভুখ মিটায় বাবু”
জানতে চাইলাম
চাষবাস জানা আছে কি না ব্যাটাদের ; সে ঘাড় নেড়ে না বললে।
জিজ্ঞেস করলাম “
জন্তু জানোয়ার পোষা হয় না ?”
কিছুক্ষন
ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে বিনু মারান্ডী। তারপর তার ভাঙ্গা হিন্দিতে
বললে –
“ এক কালে
হাঁস-মুরগি পোষা হতো গ্রামে, কিন্তু হাঁড়িয়ার সাথে ‘চাট’ ভারি দরকারি; সেই চাটের
জোগান দিতে গিয়ে তারা সম্পূর্ণ নিকেশ হয়ে যায়। এদিকে মেয়েমানুষ ছাড়া জিন্দেগী চলতে
পারে, কিন্তু চাট ছাড়া হাঁড়িয়া কি ভাবে রুচবে ? এ গ্রামে এক ধরনের বুনো খটাশ পাওয়া
যেত; এরপর সবাই সেই খটাশ পাকড়াও করতে
লাগলো চাট বানাতে; ধীরে ধীরে খটাশ খতম হয়ে গেল। বুনো শেয়াল মাঝে মাঝে এ গ্রামে
আসতো, তারপর তাদের ধরে কতল করা হতো হাঁড়িয়ার চাটের লোভে। তারাও নির্বংশ হলে এ
গ্রামের মানুষ বট-অসত্থে ঝুলে থাকা বাদুড় ধরে খেতে শুরু করে; বাদুড় পোড়া আর
হাঁড়িয়া চলে বেশ কিছুদিন। কিন্তু অল্প সময়েই বাদুড়ের গুষ্ঠিও হাপিশ হয়ে যায়। তারপর
কিছুদিন চললে ব্যাঙ মেরে খাওয়ার রেওয়াজ ; কিন্তু তারা আর কতদিন টিকবে বাবু ?”
আমি থ মেরে
গেলাম। জিজ্ঞেস করতেই হলো, “ তবে এখন তোমাদের হাঁড়িয়ার সাথে চাটের ব্যবস্থা কি করে
হয় হে বিনু ?”
বিনু বিমর্ষ ভাবে
বললে “ আজকাল মানুষ কমে আসছে বাবু, মানুষ কমে আসছে”, বলতে বলতে বিনু কোমরের
কাটারিটা খুলে হাতে নিয়ে আমার গা ঘেঁষে এসে বসলে।
( এটি আদ্যপান্ত গ্যাঁজা নয়, আদত ব্যাপারটা রয়েছে শ্রী অনিমিখ পাত্র’র এই
ফেসবুক আপডেটে )
Comments