Skip to main content

মুলাকাত

সমুদ্দুরের ধারে বসেরাত সোয়া এগারোটাশেষ ডিসেম্বরছ্যাত করে ছুয়ে যাওয়া হাওয়াপুরোনো দীঘার সৈকত-চত্তর প্রায় সম্পুর্ন ফাঁকাশেষ চা-ওয়ালা এলুমিনিয়ামের বালতি বয়ে ওয়াপস চলে গেছে আধ ঘণ্টা আগে। এই ঠান্ডায় একটু চা পেলে মন্দ হতো না কিন্তু উপায় নেই; তার জন্যে হোটেলে ফিরতে হবে। কিন্তু বসে থাকতে থাকতে নেশা ধরে গেছিলো। উঠতে গভীর অনিচ্ছা। অগত্যা গায়ের শালটাকে আরও আঁকড়ে বসলাম।

অফিসের সঙ্গী-সাথীরা হোটেলে আড্ডায় মশগুল। ফেরত গেলে সেই গতানুগতিক আধো-অফিস-আড্ডা। ধুর সমুদ্রের ধারে এমন নিরবিলি খুঁজে পেলেই বাপ্টুদার সেই অমোঘ বাতেলাতা মনে পড়ে যায় ; “ সমুদ্রের বালি-জল-হাওয়া মেলানো পরিবেশের মত এমন ল্যাদানুকূল পরিবেশ আর হয় না। হুল্লোড় বিহিন সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকার চেয়ে স্বাস্থকর মেডিটেশন আর হয় না।

ছোটমামা বলেন; পুরীর সমুদ্র হচ্ছে সত্যজিত আর দীঘার সমুদ্র হচ্ছে সন্দীপ। অনস্বীকার্যতবে পুরোনো দীঘার সৈকতের এই বিশেষ নিরবিলি অঞ্চলটি আমার ভীষণ প্রিয়, খোঁজ দিয়েছিলো ছোটমামা'ই

আলু-থালু ভাবতে ভাবতে চোখে একটু ঝিম লেগে এসেছিলো এমন সময় অনুভব করলাম পিঠে কেউ হাত রেখেছে।
ঘুরে দেখি এক বৃদ্ধ; অতি-শীর্ণ চেহারা, এই শীতেও পরনে শুধু একটা ফতুয়া যা দিয়ে বড় জোর টেবিল মোছার কাজ চলতে পারে আর হাফ-লুঙ্গি। স্বল্প চেহারা। ফিরিওয়ালাও নিশ্চয় নয়, ভিখিরি হবে বলে মনে হলো

-‘কী চাই ?’ – জিজ্ঞেস করতেই হলো।
-‘ কিছু না – পাতলা কণ্ঠস্বর কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণ বৃদ্ধের।
-‘কিছু না মানে ? ডাকলেন কেনো ?’
-ডেকেছি কোথায় ? পিঠে হাত রেখেছি তাজ্জব করে দিয়ে বললেন।
- মানে ? কেনো ?’
-অবাক হলে কেনো ? একজন মানুষ তার সহ-মানুষের পিঠে হাত রেখেছে, সেটা একটা মানুষ কে অবাক করবে কেনো?’
-ধুর মশাই, কে আপনি’, বৃদ্ধর ভাষা শুনে সচেতন না হয়ে উপায় নেই।
-একটা ভুল বলে ফেলেছি। মানুষ এক মানুষের পিঠে হাত রাখেনি। আমি ভূত। একটা ভূত একটা মানুষের পিঠে হাত রেখেছে, এটা অবশ্যই নরমাল নয়, তবে মানবিকতায় আমি কোনো মানুষের থেকে কম যাই না
-কী আবোল-তাবোল হচ্ছে এটা দাদু ? বাংলা মেরেছেন নাকি ? আর আপনার কথা আর পোশাক তো মিলছে না?’
-চমত্কার পোশাক পরে যারা বন্দুক চালায়,তাদের কাজ আর পোশাক মেলে ? মিলতে হবে এমন কে দিব্যি দিয়েছে, তোমার পাশে একটু বসবো ?’
-বসুন, কে বারণ করেছে?’ বুড়ো কে ইন্টারেস্টিং ঠেকছিলো।
- নিজেকে ভূত বললেন কেনো?’ আমার হাতে বিস্তর সময়, আড্ডা মারতে আপত্তি নেই। নিজেই জিজ্ঞেস করলাম
-কারণ আমি মৃত, তাই
-ধুর
-তুমি শুধু ধুর বলতে চাওনি, তাই না? ধুরয়ের পর একটা খিস্তি চাপ ছিলো, তাই না ?’
-দাদু আপনার বাক্যি-এলেম আছে কিন্তু হাইলি-শাসপিশাস কেস আপনি। আমাকে পাকড়াও করলেন কেনো ?’
-‘এ গ্রহের একজন সহ-বাসিন্দা একলা বসে ছিলো; আমি তাকে সঙ্গ দিতে এলাম তুমি বিরক্ত হলে বা একা থাকার নিতান্ত দরকার থাকলে সরে যাবো
-আপনি এমন পোশাকে ঘুরছেন কেনো ?’
-ধর যদি বলি আমি ছদ্মবেশে আছি ?’
-‘ছদ্মবেশে কেনো আছেন? আর আমার কাছে ধরাই বা কেনো দিচ্ছেন?’
-বলবো। বলো তো বাবা, তুমি এখানে একা বসে কী করছিলে?’
- ল্যাদ খাচ্ছিলাম
-তুমি কোথায় থাকো?’
-কলকাতায়, জেনে আপনার লাভ
-কোলকাতা? বা:, সঠিক আন্দাজ করেছিলাম তোমার মত ছেলেকেই আমার বিশেষ দরকার
-ইয়ারকি পেয়েছেন নাকি ?’
-সত্যি দরকার, সাহায্য করবে?’
-আগে শুনি, আপনি কে
-আমি শ্রীযুক্ত সৌমিত্র হালদারআমার আদি-নিবাস; পুণ্য-তীর্থ কলকাতায় কলকাতা শহরের একটি সরকারী স্কুলে সম্মানীয় হেডমাষ্টার ছিলাম। এখন বাংলা-উড়িষ্যার সীমানা সংলগ্ন একটা গ্রামে থাকি। দিনমজুরি করতে মাঝে সাঝে দীঘায় আসি। আর মাঝে মাঝে আমার কলকাতার আমার একটা বিশেষ কাজের জন্যে লোক খুঁজি, এই যেমন তোমায় দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার ছোট্ট কাজটা করে দেবে? করে দেবে তো?’
-হেডমাস্টার থেকে দিন-মজুর? মানে ?’

- আরবনাইজেনশন আমায় নি:স্ব করে দিয়েছিলো ভাই। আমার এক মাত্র পুত্রটিকে ড্রাগ কেড়ে নিযেছিলোকন্যাটি চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে বদ হাতে পড়ে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলোআমার স্ত্রী গুমরে গুমরে কাটাচ্ছিলো। দুপুর বেলা সে ফ্ল্যাট-বাড়িতে এক ছিলো, কার্ডিয়াক এরেস্ট। প্রতিবেশীদের সামান্য সাহায্য পেলো না, আমি সন্ধ্যে বেলা এসে দেখি সব শেষ। ঘেন্না ধরে গ্যালো শহরের ওপর; শহুরে সমস্ত মানুষের ওপর; গোটা আরবান সিষ্টেমের ওপর’, বলতে বলতে বৃদ্ধ থর থর করে কাঁপছিলেন, আমার বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
- তা আপনার কাজটা কী ?’, জিজ্ঞেস করতেই হলো।
-করবে তো?’, সমুদ্রের ফেনার মত চিকচিক করে উঠলো বৃদ্ধের দুই চোখ।
-‘শুনি কী কাজ?’
- খুব সহজ, কলকাতায় পৌছে; শহরের যে কোনও বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে, ঘেন্না নিয়ে এক মুখ থুতু ফেলতে হবে আর একবার চিত্‍কার করে বলতে হবে সৌমিত্র হালদার কলকাতাকে, দুনিয়ার সব শহরদের এবং শহুরে যা কিছু আছে; সমস্তটাকে ঘেন্না করে, শহুরে সভ্যতাকে লাথি মরে সৌমিত্র হালদার”।

অস্বস্তিতে উঠে পড়লাম। বৃদ্ধ পাঞ্জাবীর আস্তিন টেনে ধরলেন। জোর করে ছাড়িয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটা লাগালাম হোটেলের দিকে। পিছণ থেকে বৃদ্ধ প্রায় প্রলাপের ভঙ্গিতে আউড়ে চলছিলেন:  “কলকাতার বুকে  আমার হয়ে থুতু ফেলবে তো ভাই ? বলবে তো আমি শহুরে সমস্ত কিছুকে কে লাথ্থি মারি ? বলবে তো ? বলবে তো?”
  


Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু