Saturday, March 24, 2012

প্রথম সিগারেট

(সূত্র:"আমার প্রথম সুখটান; ৩ মার্চ, ২০০০। একটি সিগারেট খেয়ে, প্রচুর ক্লোরোমিণ্ট হজম করে, তিনটি ঘন্টা বাইরে কাটিয়ে, তবে ঘরে ঢুকেছিলাম। সুখ-স্মৃতি"- অর্জুন)


মাধ্যমিক খতম। আমি এখন রাজা, আমি এখন ডাইনোসোরআমি এখন পিরানহাযতদিন না রেজাল্ট বেরোচ্ছে, আমি প্রক্সীমা-সেঞ্চুয়ারী; ঝিলিক মারবো, কিন্তু কারুর হাতে আসবো নাপিতা, মেজদা, ছোটোমামার রেডিয়াসের বাইরে এখন আমার অস্তিত্বরেজাল্ট বেরোলে আড়ং-ধোলাই জুটবেইঅতএব তার আগে যতটুকু পারি মৌজ করে নিতে হবেনটায় ঘুম থেকে উঠছি, দেদার ফেলুদা-টিনটিন পড়ছি, দিনে দু ঘন্টা মাছ ধরছি কেল্টোদের পুকুরে, পাড়ার টিমে রাইট ব্যাকের জায়গাটা প্রায় কব্জা করে ফেলেছি, আর দিনে একটা করে সিনেমাএমন মাধ্যমিক বার বার আসুক

তুরীয় জীবন বয়ে যাচ্ছিলো। এক চড়া রোদের দুপুরে মাথায় ছাতা মেলে, কেল্টোদের পুকুরে ছিপ ফেলে বসে অছিফাতনার দিকে চেয়ে গুণ গুণ করে অঞ্জন দত্ত গাইছি আর মুড়ি চিবোচ্ছিচোখে অল্প অল্প ঘুম লেগে আসছে, এমন সময় গদাম শব্দে “পচা” শুনে মনোসংযোগ চটকে গ্যালোফিরে দেখি বাবলা, ক্লাসমেট এবং দোস্ত

-“হোয়াট টাইম ওয়েস্ট পচা, মাছ ধরছিস?”
-“চুপ শালা বাবলা, চিল্লাস না, মাছ ভেগে যাবে”
-“মাছ ভাগে তো ভাগুক, এসব ছেলে খেলা ছাড়, পুরুষ মানুষ হয়েছিস, কিছু কাজের কাজ কর...”
-“আবার চালিয়াতি?”
-“ওরে না রে, একটু ছিপ খানা সরা দেখি, একটা ম্যাজিক দ্যাখাবো!”
এই বলে বাবলা পকেট থেকে বের করে আনলো একটা বোমা, না বোমা নয়...তবে কমও নয় কিছু। একটা আস্ত সিগারেট।
-“বুঝলি পচা, এই হলো নেভি-কাট।কাকার পকেট থেকে সদ্য-হাত সাফাই করা। দেশলাই মেরেছি মার ঠাকুরের আসন থেকে। কবি বলে গ্যাছেন না? ‘থাকবো না আর বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগত্‍টাকে’? টাইম টু সি দ্য জগত্‍ বন্ধুপুরুষমানুষ হয়ে যদি সিগারেটই না খেলি তবে আর পুরুষ হয়েছিস কেন?”
-“কিন্তু তাই বলে সিগারেট? যদি...যদি ঘরে জেনে যায়?”
-“উহহ, ইউ আর এ নেকু। এত ভয় নিয়ে দেশ গড়বি পচা? আরে ভয় কী? তোর বয়সে বিবেকানন্দ হাজার হুঁকো ফূঁকে উড়িয়ে দিয়েছিলো, আর তুই এই সিগারেটের এক টানে ভয় পাচ্ছিস? শেম অন ইউ পচা। তুই আমার বন্ধু ভাবতে লজ্জা করছে আমার”
-“তুই খেয়েছিস আগে?”
-“না:, এই প্রথম,  আর প্রথম সুখ-টানের পুন্য আমি তোর সাথে ভাগ করে নেবো না, এমন নেমকহারাম বন্ধু আমি নই হে পচারাম”

কাঁপা হাতে বাবলা সিগারেট ধরালো, অনভ্যাসে প্রায় পুড়ে যাচ্ছিলো, কোনওক্রমে জ্বললো আমাদের তামাক-সাধনা। একটা ফুরুত করে টান মেরে সিগারেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিল বাবলা। জয় মা বলে ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেটটা চেপে প্রাণ ভরে একটা শ্বাস নিলাম। যে আমেজটা মুখে ঢুকলো,তা বিস্বাদ কিন্তু মন্দ নয়। একটা পোড়া আমেজ ছড়িয়ে গ্যালো মুখে। কিন্তু এরপর ঘটলো গড়বড়। বুকের মধ্যে নেমে গ্যালো এক রাশ ধোয়া। আর শুরু বেদম কাশি। কাশতে কাশতে কেতরে পড়েছি প্রায়, শেষে পুকুরের জল মুখে ছিটিয়ে সোয়াস্তি। কিন্তু ততক্ষণে আমরা ক্ষুদিরাম আর ওই সিগারেট আমাদের স্বাধীনতা। যাবতীয় কাশি সত্বেও নিকেশ করেছিলাম সে সিগারেট দুজনে মিলে। অনভ্যাসী ঠোঁটের ঠ্যালায় ভিজে যাওয়া ফিল্টার যখন পুকুরে নিক্ষিপ্ত হল, ততক্ষণে কেল্টোদের পুকুরঘাটটা চাঁদ আর আমরা এক জোড়া আর্মস্ট্র্ং।

কিন্তু এরপর এল অন্য চিন্তা। মুখের গন্ধ কী হবে? বাড়িতে কেউ টের পেলে স্ট্রেট তক্তা বনে যাবো
“চিন্তা নট বন্ধু”, বাবলার মুখের বুদ্ধের হাসি, “বাবলা সমাদ্দার থাকতে, পচা মুখুজ্যে বিপদে পড়বে, তা কী হয়?” বলেই বাবলা পকেট থেকে একগাদা পিপারমিণ্ট লজেন্স বের করলো। পর পর পাঁচটা লজেন্স খেয়ে একটু নিশ্চন্ত হলাম। বাবলাও আমার পিঠ চাপরে কেটে পড়লো ।

আমি তখনো বাড়ি ফেরার সাহস পেলাম না। এন্তার মশার কামড় হজম করে কেল্টোদের পুকুরের ধারেই বসে রইলাম ঝাড়া তিন ঘন্টা। অন্ধকার হলে তবে ফিরলাম বাড়ি।
মেজদা কৈফিয়ত-মুখী দাদা, জানতে চাইলে দেরি হলো কেনো? বললাম “কেল্টোদের পুকুরে একটা কাতলা খুব খেলুড়ে হয়েছে, তাই...”

মাধ্যমিকের পরেই বাবলার বাবার ট্রান্সফার হয়ে গেছিলো নাগপুরে। যোগাযোগ যথারীতি কমতে কমতে একরকম থেমেই গেছিলো। এই কিছুদিন আগে আচমকা বাবলার সাথে দ্যাখা দিল্লিতে। ব্যাটা এখন একটা বেসরকারী কোম্পানির হয়ে দিল্লী তে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। কিন্তু এখনো একইরকম দিল-দরিয়া আছে, চিত্‍কার করে কথা বলার অভ্যেসটাও যায়নি। আড্ডা জমেছিলো বাবলাদের ফ্ল্যাটেই। বাবলা-বৌদির হাতের রান্না অনবদ্য। একটা বিরাশী-সিক্কার ভুঁড়িভোজ সেরে আমি আর বাবলা ওদের ব্যালকনিতে বসেছি গ্যাঁজাতে। ইতিমধ্যে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে বাবলার দিকে এগিয়ে দিতেই ভূত দেখবার মত চমকে উঠলো বাবলা।

-“সিগারেট? তুই সিগারেট খাস পচা? সে কী?”
-সে কী মানে, ন্যাকামি করছিস, নে ধরা...”
-“হোয়াট নন-সেন্স, সিগারেট আমি বাপের জন্মে বরদাস্ত করতে পারিনা, নিজে কোনোদিন খাই নি, এমনকী প্যাসিভ স্মোকিংও অপছন্দ। দেশের হচ্ছেটা কী বলতো? এত ক্যান্সারয়ের ওয়ার্নিং সত্বেও লোকে মুর্খের মত সিগারেটকে আঁকড়ে ধরে আছে, আমরা তো আমাদের বাড়িতে অন্য কাউকেই স্মোক করতে দিই না, তাই না সোনা?”, বলে আদুরে চোখে বাবলা-বৌদির দিকে তাকালো বাবলা। স্মিত সম্মতি জানালো বৌদি। আমি সিগারেটের প্যাকেটটা মানে মানে পকেটে চালান করে দিলাম।

ফেরার সময় বাবলাই বললো যে আমার ও ওর গাড়িতে করে আমায় আমার গন্তব্যে ড্রপ করে দেবে। বৌদি কে টাটা বলে আমি আর বাবলা বেড়িয়ে পড়লাম। গাড়ি তে উঠেই বাবলা বলে, “এবার সিগারেটের প্যাকেটটা বার করো দেখি চাঁদু”
-“কেনো রে শালা? এই নাকি তুই স্মোকিং বরদাস্ত করতে পারিস না?”
-“ইয়ে মানে, বউ ব্যাপারটা ঠিক এলাউ করে না। এই গাড়িতে সিগারেট খাওয়ার কথাটাও যেন ফাঁস না হয়। সাধে কী আর আমার মাসে তিনটে গাড়ির-আতরের শিশি লাগে? আর হ্যাঁ, মনে করে কোনও পান-দোকানে দাঁড়াতে হবে, খান কয়েক পিপারমিণ্ট লজেন্স কিনতে, সমঝা?” 
  

3 comments:

Subrata Majumdar said...

খুব সুন্দর লেখা হয়েছে!

আমার প্রথম (এবং শেষ) সিগারেট টানা জম্মু স্টেশনএর প্লাটফর্ম এ দাড়িয়ে। খুব বদখত লেগেছিল। বাড়ি ফিরে চেন স্মোকার বাবাকে বলাতে খুব হেসেছিল।

প্রথম সবকিছুর স্মৃতিই রোমাঞ্চকর। প্রথম মদ্যপান করে আমার এক বন্ধু আর আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলি।আমাদের বাড়ির গেটের সামনে দাড়িয়ে আমরা সপ্তর্ষি মন্ডল লোকেট করে দিক নির্ণয় করার চেষ্টা চালাছিলুম - বাড়ি ফেরার জন্যে!

Gablu said...

সাধু, সাধু বন্ধু। সবারই প্রথম সুখটানের অভিজ্ঞতাটি চরম। আলাদা করে তোমায় কিছু বলার নেই, চমৎকার লেখা। আমার tweet পড়ে এরকম লেখা বের হল! আহা ! ধন্যবাদ :)

Sanchita said...

Darun hoyeche lekha ta :) Hanste haste pete khil dhore galo :)