Skip to main content

পাপাইদা আর বিশ্বাসঘাতক



সে'কদ্দিন আগের কথা।

সে'দিন পাপাইদা বসেছিল মেঝের ওপর পাতা মাদুরে। পাশবালিশে হেলান দিয়ে। দু'বছরের মাথায় উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর ওর রোয়াব খুব বেড়ে গেছিল। বকাবকি করার সময় ইয়াব্বড় সব ইংরেজি শব্দ আউড়াত। খবরের কাগজ ঘেঁটে পলিটিকাল নিউজ পড়ত। ওর মেজকার দামী জিলেটের রেজার চুরি করতে গিয়ে দু'বার গাঁট্টাও খেয়ে ফেলেছিল। ফুলটসে বোল্ড হওয়ার পর হাওয়ার ডিরেকশন আর টেনিসবলের 'টেকনিকাল গ্যাপ' নিয়ে গা-কাঁপানো লেকচার ঝাড়ত। মোটের ওপর, পাপাইদাকে একটু বাড়তি সমীহ করতে শুরু করেছিলাম। এই যেমন একদিন বাবার পকেট থেকে পড়ে যাওয়া পঞ্চাশ টাকার নোটটাকে খামোখা পকেটে ফেরত না দিয়ে সোজা চপের দোকানে গেলাম, কিন্তু পাপাইদার প্রতি প্রবল সমীহ ব্যাপারটা মাথায় রেখে আর ওকে বেগুনিতে ভাগ বসানোর জন্য ডাকলাম না।

যা হোক, সেই দুপুরে পাপাইদার চিলেকোঠার চেম্বারে না এসে উপায় ছিল না। আমি একটা বেতের মোড়ায় লেতকে বসেছিলাম। আড়াই মিনিট পাপাইদা চুপচাপ সিলিংয়ের তাকিয়েছিল, মাঝেমধ্যে বলছিল "কোয়াইট ইনক্রেডিবল"। খানিকক্ষণ পর পাশবালিশ সরিয়ে রেখে সোজা হয়ে বসল পাপাইদা। 

- ভুতো, আর ইউ শিওর?

- আমি নিজের চোখে দেখে এলাম।

- বিট্টা আর মৌ?

- তবে আর বলছি কী।

- পাশাপাশি? 

- একদম। 

- হয়ত টিউশনি যাচ্ছিল, ওদের সাবজেক্ট তো একই। 

- কাঁধে ব্যাগ ছিল না। আর...। 

- আর কী? খুলে বল্‌ ভুতো। 

- মৌদি শা...শাড়ি পরে...আর বিট্টাদা পাঞ্জাবি...।

- ও মাই গড।

- ইয়ে, পাপাইদা। শাড়ি আর পাঞ্জাবি। ম্যাচিং।

- ম্যাচিং? ডিড ইউ সে ম্যাচিং? হোলি কাউ! দিস ইজ ডিসগাস্টিং। বিট্টাটা না হয় ইরেস্পন্সিবল লোফার ছেলে একটা। মৌ কী করে এমন শেমলেস হতে পারল...।

- ইয়ে, বাবা কিন্তু বলে বিট্টাদার মত ছেলে হয়না। আইআইটিতে পড়ছে, ভদ্র, নম্র। দুর্দান্ত টেনিস খেলে...।

- প্লীজ ডোন্ট মাইন্ড, তোর বাবা একটা সুপারগাম্বাট। সামান্য চাঁদা চাইতে গেলে তো হাজার রকমের টালবাহানা শুনতে হয়। কত জ্ঞান! উফ! পরীক্ষা সামনে এখন পুজো পুজো করে নাচলে হবে কেন। ইনফ্লেশনের বাজারে পুজোয় এত বাড়াবাড়ি ভালো না। এট সেটেরা। এট সেটেরা। সে কত রকমের ফিচলেমি। বিট্টার মত মেনিমুখো ছেলেরা যে সোসাইটির পক্ষে কতটা টক্সিক, সে'টা বোঝার মত ইন্টেলিজেন্স তোর বাবার নেই।   

- যাক গে, আমি জানিয়ে গেলাম। 

- পাড়ার একটা রেস্পন্সিবল রেসিডেন্ট হিসেবে এই মরাল ডিগ্রেডেশন আমায় রুখতে হবে।

- মরাল কী?

- সে'সব বোঝার বয়স তোর হয়নি। 

- বা রে, তুমিই না বলতে, তোমার স্বপ্ন মৌদিকে সাইকেলে বসিয়ে পুজোয় ঘোরার? বিট্টাদা তো শুধু পাশাপাশি হেঁটেইছে। 

- সবে মাধ্যমিক পাস দিয়েছিস। সব ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করিস কোন সাহসে ভুতো?

- যাব্বাবা। ইনফর্মেশনটা দেওয়াই দেখছি ভুল হয়েছে। বেশ, আমি আসি। খবরটা যখন শেয়ার করা হয়েই গেছে...।

- এই ভুতো। কুড়িটা টাকা হবে রে?

- টাকা? টাকা আমার কাছে কই। 

- তোর হাতে কাঁচাটাকা এসেছে সে খবর আমি রাখিনা ভেবেছিস? পরশু তুই শ্যামলদার দোকানে গিয়ে ছ'পিস বেগুনী খাসনি? একা একা?

- ওই, না, মানে হয়েছিল কী...।

- শাটাপ! গোটা পাড়াটা ট্রেটারে ভরে গেল। 

- তুমি বেগুনীর খবরে কনসেন্ট্রেট করলে, এ'দিনে শাড়ি পাঞ্জাবি ম্যাচিং হয়ে গেল।

- এ মায়া প্রপঞ্চময়।

আচমকা বেগুনীর উল্লেখে সত্যিই কেমন হয়ে গেছিল পাপাইদা। খটখট করে ইংরেজি চাল দেওয়া বন্ধ হয়েছিল সে'দিন থেকেই।

সে'কতবছর আগেকার কথা। 

আজ সন্ধেবেলা পাপাইদার দিল্লীর ফ্ল্যাটবাড়িতে চ্যালা মাছ ভাজা খেতে খেতে খোশ গল্প জমেছিল। পাপাইদাই ভাজছিল আর রান্নাঘর থেকে মাঝেমধ্যে এসে প্লেটে ঢেলে যাচ্ছিল। মৌদি ওদের হিমাচল ঘুরে আসার ছবি দেখাচ্ছিল। পাপাইদার ছেলেটা মহাদুরন্ত এবং হাইলি ফচকে হয়েছে। ওর সঙ্গেও দিব্যি গল্পআড্ডা জমে যায়। পাপাইদার আমায় ট্রেটার বলার গল্প শুনে মৌদি বললে ছেলেবেলার সমস্ত মার্কামারা ট্রেটারদের প্রতি নাকি পাপাইদার মায়া অসীম। 

- কী'রকম মৌদি?পাপাইদা আর কোন ট্রেটারকে আগলে রেখেছে?

- কাল তো মহালয়া। সকাল সকাল চলে আয়। নিজের চোখে দেখতে পাবি। তুইও কিন্তু লাঞ্চ করে ফেরত যাস। বাড়ি থেকে এদ্দূরে মহালয়ার দিন একা থাকবি কেন।

- সে আসা যেতেই পারে। কিন্তু কালকেও কোনও ট্রেটার আসছে নাকি?

- বিট্টা।

- বিট্টাদা?

- সে দিল্লীতেই থাকে। এই সে'দিনই আমরা জানতে পারলাম। আইএনএ মার্কেটে বাজার করতে গিয়ে দেখা। পাপাইতো বিট্টাকে জড়িয়ে ধরে নেমন্তন্ন করে একাকার কাণ্ড। বিট্টা নিজেই হতবাক। উফ, তোর পাপাইদা পারেও বটে।

- পাপাইদা সত্যিই অদ্ভুত। আমার বাবাও ওর দু'চোখের বিষ ছিল। আজকাল মাসে একবার আমার বাবাকে ফোন করে খুব খাতির করে। বাবাও দেখি আজকাল পাপাইদা বলতে অজ্ঞান।

- তবে বিট্টাকে কিন্তু ঠিক সাদা মনে ডাকেনি তোর পাপাইদা।

- কী'রকম?

- বিট্টাকে নেমন্তন্ন করেই কাপড়জামার দোকানে ছুটেছিল। সেই সন্ধেবেলাই। আমায় একটা নতুন শাড়ি কিনে দিল, আর নিজের জন্য কিনল ম্যাচিং পাঞ্জাবি। কাল বিট্টা এলে আমরা সে'টাই পরছি। 

- সত্যিই, পাপাইদার জবাব নেই।  

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু