Skip to main content

সাইক্লোন

সে এক দুর্দান্ত ঝড় আসবে। সেমি-প্রলয় গোছের কিছু। উড়ে বেড়াবে ডিশটিভির চাকতি, রাস্তায় উপড়ে পড়া গাছের ধাক্কায় তুবড়ে যাবে মারুতিভ্যানের ছাত। সে সাইক্লোন অবশ্য এখনও এসে পড়েনি। তবে সন্ধে থেকে একটানা লোডশেডিং, আর বাইরে বৃষ্টির তোড়ে ফ্যাকাসে হয়ে আসা রাতের অন্ধকার ।  খবরাখবর যে'টুকু তা জোড়া পেন্সিল ব্যাটারির ছোট রেডিওর মাধ্যমে। এ'দিকে মোবাইলের ব্যাটারি সাত পারসেন্টে নেমেছে; ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নির্ঘাৎ স্যুইচ অফ।

অনুপ সামন্ত একটানা সাতখানা হাই তুলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন।  কাহাতক ঠায় বসে থাকা যায়, মোমবাতির ঘোলাটে আলোয় একটানা বই পড়াও কষ্টকর। একা থাকার এই এক সমস্যা; 'জলের বোতলটা এগিয়ে দাও' গোছের কথা বলার কেউ নেই, 'দরজা জানালাগুলো চেপেচুপে বন্ধ করেছিস তো' বলে খোঁজখবর নেওয়া কেউ নেই।

মোমবাতিটা নেভানোর ঠিক আগে হাতঘড়িতে সময় দেখেছিলেন অনুপবাবু, রাত পৌনে একটা। আর আধ ঘণ্টার মাথায় সেই তুমুল সাইক্লোন শহরের বুকে আছড়ে পড়ার কথা; ইন্টারনেট স্যাটেলাইট ইত্যাদির যুগে আজকাল এ'সব খবর খুব একটা এ'দিক ও'দিক হয়না।

ঝড়ের রাতের অন্ধকারে একাকিত্ব ব্যাপারটা বেশ সহজেই গাঢ় হয়ে পড়ে বোধ হয়, আর তখন বড় মায়ের কথা মনে পড়ে। সামান্য তিন দিনের জ্বরে চলে গেল মা; এই গত বছর। ছেলের বিয়ে দেখে যাওয়ার বড় সাধ ছিল, হল না। কত কীই তো হয়না আর সেই না হওয়াগুলোই পোষা বেড়ালের মত চিরকাল পায়ে-পায়ে ঘুরবে।

মায়ের নরম শাড়ির ওম বড় মনে পড়ে, রাতে পাশ ঘেঁষে শুলে মা প্রায়ই গাইতেন "ভব-সাগর-তারণ-কারণ হে, রবি-নন্দন-বন্ধন-খণ্ডন হে"। মায়ের সে সুরে বুকে বাতাস বইত; ঝড়টড় নয়, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শেষে ছাতের টাবে রাখা নয়নতারার মাথা নুইয়ে দেওয়া মখমলি হাওয়া। সে সুরের জন্য বড় মন আনচান করে আজকাল। আর সে আনচান বাড়লেই ঘরের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে টাঙানো মায়ের ফ্রেম করা ছবিটার দিকে নিবিষ্টচিত্তে তাকিয়ে থাকেন ভদ্রলোক। আজও সে দেওয়াল তাক করে টর্চের আলো ফেললেন অনুপবাবু, সে আলোয় মায়ের মুখ যেন আরো উজ্জ্বল মনে হল। নাকের নীচের অংশটুকু ধরে বিচার করলে মায়ের সঙ্গে অনুপবাবুর মুখের হুবহু মিল।

বেঁচে থাকতে মা অবিশ্যি জ্বালাতনও কম করতেন না, বেশ বাতিকগ্রস্ত ছিলেন তিনি। অফিস থেকে বেরোনোর সময়  থাকত হাজার রকমের প্রশ্ন; মানিব্যাগ নিয়েছিস তো? টিফিনবক্সের সঙ্গে আলাদা একটা ছোট কৌটে অল্প খেজুর দিয়েছি, খেতে ভুলবি না তো? ফিরতে দেরী হলে আগাম ফোনে জানিয়ে রাখবি তো? দৌড়ে বাসে উঠবি না তো? এমন আরো খানকুড়ি প্রশ্ন, রোজ। আর এমন ঝড়ের রাতে না জানি মায়ের কাছে কত কৈফিয়ত দিতে হত; বারান্দার টবগুলো ভিতরে এনে রাখা হয়েছে কিনা, ছাতে কোনো কাপড় মেলা আছে কিনা, টিভি ফ্রিজের প্লাগ খোলা আছে কিনা; এমন হাজারো প্রশ্ন বারে বারে তেড়ে আসত অনুপবাবুর দিকে। আর সেই সব প্রশ্ন আর আকুতির অভাবটা অনুপবাবুর বুকে বড় বাজছিল, বাতাসের শোঁশোঁ শব্দ গলায় ঘুরপাক খাচ্ছিল যেন। অবিশ্যি ঝড় শুরু হয়নি এখনও, তবে 'এনিটাইম নাউ' পরিস্থিতি।

চমকে উঠতে হল খট করে বিশ্রী শব্দটা হওয়ায়, মায়ের ছবিটা দেওয়ালের পেরেক উপড়ে মেঝেয় পড়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে কাচ। আড়মোড়া ভেঙে খাট ছেড়ে উঠলেন অনুপবাবু। মায়ের ছবিটা যত্ন করে তুলে পাশের টেবিলে রাখলেন। বড় কান্না পাচ্ছিল; এমনটা হয়, যাদের মা না থাকে; তাঁদের তো হয়ই।

তখনই খেয়াল পড়ল পাশের দেওয়ালের জানালাটা আধ-খোলা, বাতাসের শব্দে মালুম হচ্ছিল গতিবেগ বাড়ছে। ছুটে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করলেন অনুপবাবু, আর সামান্য দেরী হলেই বিশ্রী কাণ্ড ঘটত।

**

গীতাদেবী স্বস্তি পেলেন।

খোকাটা আগের মতই বেখেয়ালি রয়ে গেল, হাজারবার এক কথা কানের কাছে ঘ্যানরঘ্যানর না করলে বাবুর কিছুতেই জরুরী কাজগুলো মনে থাকবে না। আগে তাও চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে কাজ সেরে ফেলা যেত, এখন তার বদলে বিশ্রী সব কাণ্ড ঘটাতে হয়। এই যেমন আজ এই ঝড়ের রাতে জানালার খোলা পাল্লার দিকে খোকার নজর টানতে গিয়ে নিজের ছবির ফ্রেমটাকেই ভেঙে ফেলতে হল।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু