Skip to main content

মাধুকরী


ঘুগনি। পাঁঠার কিমা ছড়ানো আবেদনময় ঘুগনি। এলুমিনিয়ামের ডেকচিতে টগবগ করে ফোটা পিকাসো মেজাজের ঘুগনি।

মোড়ের মাথার মাধবদা’র ঠেলা।  থরে থরে ষ্টীলের প্লেটে ঘেরা ঠেলার চারপাশ। কেরোসিনের পাম্প দেওয়া স্টোভের গনগনে আঁচ। তার ওপরে মোহময় সেই ডেকচি। যার ভেতরে ফুলে ফেঁপে উথলে উঠছে ঘুগনিয় ঈশ্বর। পাশে প্লাস্টিকের মাঝারি মাপের সবুজ গামলার তিন ভাগ জুড়ে কুচোনো পেঁয়াজের ঢিপি আর বাকিটা জুড়ে লংকা কুচি।
ঠেলার অন্য প্রান্তে রয়েছে ষ্টীলের একটা বেয়াড়া সাইজের বাটি – ওতে আছে তেঁতুল গোলা জল। সঙ্গে এক এলুমিনিয়াম গামলা সেদ্ধ খোসা না ছাড়ানো ডিম এবং এক বড় থলি ভরা মোহন বেকারির লম্বা পাউরুটি।

মাধবদা ঠিক সন্ধ্যে ছটায় ঠেলা নিয়ে মোড়ের মাথায় আসেন। ঘুগনি গরম করে নিতে তার লাগে মিনিট কুড়ি। তারপর তার ঠেলা ঘিরে খরিদ্দার জমতে থাকে। তিন ধরনের খরিদ্দার;
এক দল যারা শুধু ঘুগনি খান।
একদল যারা এক প্লেট ঘুগনি খেয়ে একটা বা দুটো ডিম সেদ্ধ খান।
আর আর এক দল যারা ঘুগনিতে ভিজিয়ে পাউরুটি খান।
মাধব’দার ঘুগনি পরিবেশন দেখাবার মত ব্যাপার ছিল। খদ্দের নতুন হলে জিজ্ঞেস করে নিতেন নুন-ঝাল-টক কেমন পড়বে ? মাধবদা বলতেন;
“শুধু ঘুগনি কাঁচা মাটির মত ব্যাপার, তাতে তুমি কেমন ভাবে পেয়াজ-লংকা কুচি তেঁতুল জল, বিট নুন ছড়িয়ে চাস-আবাদ করবে সেটা তোমার ব্যাপার। কাজেই খদ্দেরের থেকে আগে জেনে নিতে হয় যে সে কেমন স্বাদ চাইছে।  নয়ত দেখব সে চাইলে ধান; আমি ফলিয়ে দিলাম ফুলকপি। বুঝলে ?”      

মাধবদা অতি যত্নে প্লেট চামচ ধুতেন। ঝকঝকে প্লেটে গরম ধোঁয়া ওঠা পাঁঠার ঘুগনি; তার ওপর পেঁয়াজ কুচি-লংকা ছড়ানো, তেঁতুল জল মিশিয়ে নেওয়া। আহা:, ভাবলেই জিভে-চোখে জল চলে আসে।

ঠিক সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মধ্যে মাধবদা’র ভাঁড়ার সম্পূর্ণ ভাবে খতম হয়ে যেত; গোটা বছর, প্রত্যেক দিন। দিনে এই সোয়া ঘণ্টার ব্যবসা চলত মাধবদার। সেই সোয়া ঘণ্টা পাশের অন্য ঘুগনির দোকানগুলো মাছি মারত, মাধবদা ঠেলা সরিয়ে চলে গেলে তবে তাঁদের ঘুগনি বিক্রি খোলতাই ভাবে শুরু হত। এমন ছিল মাধবদার ঘুগনির সুনাম।

একদিন মাধবদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে সে আরও বেশি করে ঘুগনি-ডিম সেদ্ধ নিয়ে আসে না কেন। তাহলে সে আরও বেচতে পারতে; আরও মুনাফার সুযোগ থাকত। এক গাল হেসে মাধবদা বলেছিলেন;

“ আরে ধুর, এতেই যা দু পয়সা আসে তাতে আমার দিব্য চলে যায়। আরে বাবা, আমি কি ব্যবসা করি না কি গো ? আমি করি মাধুকরী। দরকারের বেশি পয়সাকড়ি নাড়াচাড়া করে তারপর চিন্তায় চিন্তায় গোল্লায় যাই আর কি। আমাকে বোকা ঠাউরেছ ?”      

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু