
কলেজ স্ট্রিট ঘেঁষে যে চার বছর'এর মেস-phase কেটেছে, সেই সময়কর ফুড-হ্যাবিট নিয়ে কিছু কথা ব্লগ রেকর্ডে ঢুকিয়ে রাখা উচিত। ফর ফিউচার রেফারেন্স। বিশেষ করে মমতা যদি সত্যিই কলকাতা'কে লন্ডনে কনভার্ট করতে পারেন (দিদি'র একটা প্রোগ্রেস থিম আছে না? কলকাতা কে লণ্ডন, দার্জিলিং কে সুইজারল্যান্ড এবং দীঘা কে গোয়া?), তাহলে এসব খাওয়ার-দাওয়ার'গুলো ফসিল-স্মৃতি হয়ে যাওয়ার হেভী চান্স আছে। তখন আমি গ্র্যাজুয়েসন করছি ক্যালকাটা উনিভার্সিটি থেকে। থাকছি আমহার্স্ট স্ট্রীট পোস্ট অফিসের উল্টো দিকের এক ছোট্ট গলি সীতারাম ঘোষ স্ট্রীট'এর এক মেস বাড়িতে। সেই সময় খাওয়া-দাওয়ার প্যাটার্ণ ছিল বেশ সোজা সাপটা। রাত তিন'টের আগে ঘুমতাম না, তাই বেলা এগারো'টার আগে ঘুম ভাঙ্গতো না, তাই জলখাবারের কোনও পাট কখনোই ছিল না। কখনো কখনো মেস'এর নিচের অমিত'এর চা'এর দোকান থেকে ডিম-পাউরুটি অবশ্য খাওয়া হত, তবে সাধারণত ব্রেকফাস্ট ব্যাপারটা উহ্যই থাকত। দুপুর'এর খাওয়া এবং রাত'এর খাওয়াটা মেস'য়েই হত।
অতএব কলেজ স্ট্রীট'এর ফুড-হাণ্ট চলতো শুধু সন্ধ্যে বেলার খাওয়াটুকুর জন্য। (সন্ধ্যে বেলার খাওয়া কে কি বলে? নাস্তা?টিফিন?জলখাবার?)। তখন অবশ্য পকেট মেপে চলতে হত, কাজেই বিকেলের টিফিন'এ জমিদারী করার স্কোপ থাকত না। তবে তার মধ্যেই উত্তর কলকাতার এই অঞ্চলে কম ভ্যারাইটি চেখে দেখিনি। সেইসময়কার প্রিয় দশ'টা সান্ধ্য-খাদ্য'এর লিষ্টি নীচে করলাম।
তবে নিচের কোনটাই প্রায় কলকাতা'র লিজেন্ড ঘেঁটে নেওয়া নয়, ব্যক্তিগত রুচি (এবং পকেট)'এর ওপর নির্ভর করে বানানো, একান্ত ব্যক্তিগত পছন্দের টিফিন লিস্ট এটা:
১। চিকেন কবিরাজি, দেলখোশ রেষ্টুরেন্ট, কলেজ স্ট্রিট মোর:

২। মটন/চিকেন আফঘানি কাটলেট, ইন্ডিয়ান কফি হাউস, কলেজ স্ট্রীট মোর'এর কাছে:

না স্যার, এতো রেষ্টুরেন্ট নয় তাই বসবার জায়গার সওয়াল নেই, ক্যান্টিনের ছোট্ট জানলা দিয়ে আপনার দিকে প্লেট বাড়িয়ে দেওয়া হবে, প্লেট হাতে কলেজ স্কোয়ার'এর বেঞ্চিতে বসে খাওয়া।গোল মরিচ ছড়ানো ফ্যাট-ফ্যাটে সাদা মুরগির স্ট্যিউ যাতে থাকত ছোট্ট এক পিস মুরগির অল্প মাংস মাখা হাড় প্লাস কিছু সব্জী এবং লম্বাটে পাউরুটি দু পিস। তখন ভীষণ ভাল লাগতো খেতে সেটা। দাম, যদ্দুর মনে পড়ে বারো টাকা। এখানে এই আইটেম বাদে কোনও কিছুই ট্রাই করিনি কখনো।
রেষ্টুরেন্টটা বিশাল কেতা-দুরুস্ত কিছু নয় কিন্তু এদের মোগলাই'টা ব্রিলিয়াণ্ট, ঝাল এবং ভারী : এত পুরু মোগলাইই পরটা খুব কম খেয়েছি, এ ছাড়া এদের সঙ্গে যে আলু'র তরকারীটা দিত সেটার মধ্যে কোনও মোগলাই কোয়ালিটি তেমন না থাকলেও; সুপার ফাইন বাঙালি-আলু চচ্চড়ি হত উইথ সুপার-ঝাল। আমার খাওয়া অন্যতম সেরা মোগলাইই পরোটা।
৫। মটন টিক্কা আর রুমালি রুটি, অন্নপূর্ণা রেষ্টুরেন্ট, টুওয়ার্ডস শেয়ালদা : মটন কিমা আর ছাতুর কম্বিনেশন যে এত সাংঘাতিক সুস্বাদু হতে পারে এদের মটন টিকিয়া না খেলে বোঝা যাবে না। এক পা এগিয়ে বলি, এদের মটন টিকিয়া এককেবারে কলকাতা বেস্ট। আর সঙ্গে সুপার ফাইন রুমালি রুটি। আজ ভাবতে গেলে জ্বিভে জল আসে। চার'টে রুমালি রুটি আর একটা মটন টিকিয়া তখন সতেরো টাকায় হয়ে যেত। এটা আমার ইসস্পেশাল টিফিন'এর লেভেলে পরতো।
এমনিতেই এটা একটা ল্যান্ডমার্ক দোকান যাকে বলে, এদের ছোলার ডাল টা যাকে বলে তুরীয়, হাফ ডজন কচুরী কোথায় যে ভ্যানিস হয়ে যেত..
৭। রাধাবল্লভী-আলুর দম/ঢাকাই পরোটা, সুরভি মিষ্টান্ন ভান্ডার, আমহার্স্ট স্ট্রিট-হ্যারিসন রোড ক্রশিং'এর কাছে :

রাধাবল্লভী টা সত্যিই ক্লাস বানাতো, মিষ্টি-ঝাল আলুর দম'টাও চেখে দেখবার মত। ঢাকাই পরোটা'টা ছিল নোনতা খাজা আর কচুরীর মিক্সচার, সাইজে বিশাল, একটাতেই পেট ভরে যেত; ওপরে ছোলার ডাল ছড়িয়ে সার্ভ করা হত; বেশ টেষ্টি!
একান্তই ব্যক্তিগত অভিরুচি এবং ভীষণ ভালোবাসা মেশানো খাওয়ার জায়গা ছিল এই খোকনদার চাউমীনের দোকান। আমাদের মেসের ঠিক নীচেই ছিল এই দোকান'টা। দোকান বলতে গলি'র ধারে ছোট্ট একটা আস্তানা, সামনের বেঞ্চিতে বসে খাওয়া। এখানের সেরা কম্বো একটাই; হাফ প্লেট এগ চাউমিন (সরু থ্রেডের চাউ, ওপরে ফ্রি চিলি চিকেনের গ্রেভী ছড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ সহ) এবং এক পিস চিকেন পকোড়া। ভীষণ টেষ্টি অথচ অতি-মসলায় দুষ্ট নয়; ভরপেট মাত্র দশ টাকায় ছিল এ সব কিছু তখন। দারুন না?
এটা আর একটা ইতিহাস মার্কা 'বড়' দোকান। বহু রকমের সরবত রাখতো এরা, গরম কালে তো এদের সরবতের কোনও তুলনাই ছিল না । তবে এদের ম্যাঙ্গো, ব্যানানা যাবতীয় হিজিবিজি ফ্লেভার গুলোর মধ্যে সব চেয়ে বেশি প্রিয় ছিল আমার এই রোজ সিরাপ সরবতই; এটাই মনে হয়ে তখন সব চেয়ে সস্তাও ছিল; পাওয়া যেত দশ টাকায়।

বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় এবং পেট'এর চনমনে খিদে'র সময় যদি টাকা কম থাকত, তখন সেরা সাপোর্ট সিস্টেম ছিল কলেজ স্কোয়ারের এই হাড়ি-গরম ফিরিওয়ালারা। হাড়ি'র আগুনে গরম করা চানাচুর'এর মধ্যে পেয়াজ, নূন, লংকার সলিড মিশেল, অপূর্ব সে স্বাদ। তবে আজব ব্যাপার সেই হাড়ি-গরম চানাচুর কলেজ স্কোয়ারে বসে খেলে যতটা জ্বিভে জল আনতো, তার সিকী ভাগ স্বাদও অন্য কোথাও হাড়ি-গরম খেলে পাই না।
সংযোজন:
কালিকার চপের দোকান, সূর্য সেন স্ট্রীট
ফুড স্টেশন, কলেজ স্ট্রীট (একটু পকেট-হেভী ব্যাপার, তুলনামূলক ভাবে)
বসন্ত কেবিন, কলেজ স্ট্রীট
(পুনশ্চ: কলেজ স্ট্রীট'এর যাবতীয় খাদ্য স্মৃতি ঘেঁটে দেখলাম, যে বহু খাওয়া-দাওয়ার হিসেব এখনো বাকি রয়ে গেল, এই পোস্ট ভবিষ্যতে সেই বাদ থাকা গুলো জুড়ে নিয়ে আরও পুষ্ট করে তুলতে হবে।
Comments
আমহার্স্ট স্ট্রিটে "গুঞ্জন" বলে একটা দোকানে অসামান্য পর্ক চাউমিন বানাত, মাত্র ২২ টাকা প্লেট ছিল, খেয়ে শেষ করা যেত না। উঠে গেছে। :(
হিন্দু হোস্টেলের সামনে সেই লোকটার পরোটা আর ঝাল আলুর তরকারি... :(