Skip to main content

রিটায়ারমেন্ট


অনুপবাবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। পাশে তখন সহকর্মীরা একে একে স্যালুট জানিয়ে চলেছে।  এই গতকাল পর্যন্ত যারা পিছন পিছন কাঠি হাতে ঘুর ঘুর করেছে তাঁদের গলা আজ বুজে আসছে। 


কেউ বুঝল না। কেউ চিনল না। অনুপবাবুর বুক হুহু করে ওঠে। সদ্য পাওয়া শালটা খামচে ধরে নিজেকে সামলে নেন তিনি। গাড়ি নাকি এক ড্রাইভারের হাতে থাকলে সুস্থ থাকে, অথচ আজ মনে হচ্ছে বহু হাত ঘোরা হয়ে গেছে। অফিস গসিপ, বসের খিচিরমিচির, সম্পর্কগুলোর থেকে মিউচুয়াল মাখন দেওয়ানেওয়া; আচমকা অফিসের দেওয়াল ঘড়িতে বিকেল পাঁচটার ঘণ্টা শুনে বড় মন কেমন হয়ে গেল। 


প্রভিডেন্ড ফান্ড ব্যাপারটায় যে কত ধানে কত চাল সে'টা এবার ঠাহর হবে। সকাল বেলা বাস ট্রামের ভিড়ে হদ্দ হতে হবে না সে'টা ভেবে কিছুদিন বেশ চনমনে লাগছিল বটে। কিন্তু চোখের সামনে হঠাৎ হাজার হাজার রোববার দেখতে পেয়ে কেমন অস্বস্তি শুরু হল। ডিমিনিশিং মার্জিনাল ইউটিলিটি এমন ভাবে কলার টেনে ধরলে যে বুকের মধ্যে হঠাৎ একটা বিশ্রী হাঁসফাঁস শুরু হল। ওদিকে তখন হিউম্যান রিসোর্সের শেখরবাবু "শেখরবাবুকে ছাড়া আমাদের অফিস অন্ধকার" বলে একটা মায়া জড়ানো আবহাওয়া তৈরি করে ফেলেছেন। অনুপবাবুর কিছুতেই মনে করতে চাইলেন না যে গত সপ্তাহেই শেখরবাবু তাঁকে "হাড় জ্বালানো বুড়ো" বলেছিলেন। 

অনেক কিছু ভেবে রেখেছিলেন অনুপবাবু। 

রিটায়ারমেন্টের পর গোপালপুরে একটা মাই ডিয়ার ছাদওলা বাড়ি কিনবেন। সেই ছাদে বেতের চেয়ার টেবিল। টেবিলের ওপর ধবধবে চায়ের কাপ প্লেট। একটা বাটিতে অল্প ঝাল চানাচুর। বিকেলের ফুরফুরে হাওয়া, সমুদ্রের কানে আরাম দেওয়া গর্জন আর পাশে গিন্নীর গুনগুনে নজরুল। 

এই ভাবে টুপটাপ কেটে যাবে। তারপর চুপচাপ বেরিয়ে যাওয়া, তখন মুখে বুদ্ধের হাসি। 


কিন্তু সব মোটামুটি গুবলেটে এসে ঠেকেছে। 

কলকাতার ভিড়ের বাইরে গেলেই বাড়তি অক্সিজেনের ঠেলায় বুকে কষ্ট হয়।
গড়িয়াহাটের ভিড়ে হপ্তায় একবার চুবনি না খেলে গিন্নীর অম্বলের হোমিওপ্যাথিক ওষুধ হজম হয় না। 


গোপালপুর নিয়ে দু'চারটে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই শেখরবাবু কাঁদো কাঁদো গলায় ডাকলেন;
"এইবার আমি অনুরোধ করব আমাদের সবার প্রিয় দাদা আর একজন বড় মাপের মানুষ; অনুপদাকে দু'টো চারটে কথা বলতে"। 

হঠাৎ একটা ফিক হাসি এসে অনুপবাবুর মুখের তেতো ভাবটা উড়িয়ে দিল। 

তিনি বলতে শুরু করলেন; 

"হিউম্যান রিসোর্সের শেখরের খিস্তি, ডাক্তারের কানমলা আর কলকাতার ক্যাঁচরম্যাঁচরে থিতু হয়ে গেছিলাম। তিনটে পিলারের একটা আজ ধসে গেল শেখরের কান্নায়। তবু, বাকি দু'টো নিয়ে আশা করি বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পারব"। 

জনশ্রুতি এই যে প্লাস্টিক হাসির আড়ালে "ঢ্যামনা" ডাক চেপে রাখাটা শেখর সমাদ্দার দিব্যি রপ্ত করেছেন। সে কারণেই মাত্র বেয়াল্লিশ বছর বয়সেই এত বড় কোম্পানিতে হিউম্যান রিসোর্সের হোতা হতে পেরেছেন। অনুপবাবুর বক্তব্য শেষ হতে বিসলারি ভেজানো রুমালে নিজের চোখ মুছলেন তিনি।  

Comments

hexagon said…
khub bhalo likhecho.
kintu tomar blog'er color theme ta jodi ektu change koro then porte subidha hobe. black color'er opor white font ta thik pora jachhe na. khub chokhe lagche. its just a suggestion from me. baki tomar jeta bhalo lagey [:)]
Saurabh Roy said…
tanmay u should seriously consider about your career as a writer,tui ki likhechis..Khoob balo kaaj, vridhabostha ta nijer moddhe ekta koshto ar retirement is the beginning of that phase..hotat kore ek din shob kaaj shesh shesh shesh..really nice work keep writing
Sam said…
khub shundor..... kolkata'r rastay erokom onekkei dekha jai, jara kina aaj kormo jibon shesh kore rastay ghurchhen, aar nijeder jhaanpsha hoye aasha drishti diye aakash pane cheye thaken....
khub bhalo bhabe tule dhorechho

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু