Skip to main content

পিতা পুত্র

রাত দু'টো। ডিসেম্বর। 

পরের দিন অঙ্ক পরীক্ষা। বাতাসে কেমন পানিপত পানিপত গন্ধ। হাফ ইয়ার্লিতে নাকটা ঘ্যাচাং করে উড়ে গেছিল। ফাইনালে গোলমাল বাঁধলে বোধ হয় বাবা মাথা আস্ত রাখবে না। বাকি সব সাবজেক্ট তাও গোঁজামিলে উতরে যাওয়া যায়। কিন্তু অঙ্কে বারফাট্টাইয়ের সুযোগটুযোগ তেমন নেই। বাঘের চেয়ে ট্রিগোনোমেট্রি কামড়ালে বেশি রক্ত ঝরবে, এ আমি নিশ্চিত। 

নেমন্তন্ন বাড়িতে পনীরের কোপ্তা আর ভেজ মাঞ্চুরিয়ান দিয়ে সোনামুখ খেয়েদেয়ে ওঠা তাও সম্ভব, কিন্তু বাবার কাছে অঙ্ক ফেলের খবর নিয়ে হাজির হওয়ার চেয়ে বেশি গিলোটিনিও কাজ আর কিছু নেই। বাবা মাঝেমধ্যেই দরাজ গলায় বলেন, "যে অঙ্ক বোঝেনা, সে পৃথিবীর বোঝা। যার নম্বর নিয়ে  হাবুডুবু খায়, তারা এস্কেপিস্ট, যে কোনও দিন কোনও ডেসট্রাক্টিভ ডায়রেকশনে ঝুলে যাবে"। 

নিজের মুখে নিজের ডেস্ট্রাক্টিভ ডিরেকশনে যাওয়ার খবর বাবাকে জানাতে বুকের পাটা লাগে। হাফইয়ার্লির মার্কশিট বাবার হাতে দিয়ে দৃষ্টিকে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল আর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের মধ্যে অসিলেট করাচ্ছিলাম। বাবা টেবিল চাপড়ে বলেছিল;
"আমার ছেলে অঙ্কে ফেল? একশোয় বাইশ? তুমি একটি জেনেটিক এমব্যারাসমেন্ট। হাজার সিসির মোটর ইঞ্জিনে জুড়ে দেওয়া কাঠের চাকা"।

সেই অঙ্ক পরীক্ষা ওয়াপস এসেছে। সেই অঙ্ক পরীক্ষা। এ'বার ফাইনাল। 

মাঝেমাঝেই মাথার মধ্যে ইকো শুনতে পাচ্ছি'; "জেনেটিক এম্ব্যারাসমেন্ট"। 
রাত বাড়ছে আর ওদিকে চোখের সামনে সাইন কস মিলে জট পাকিয়ে নাচানাচি করছে। শুনেছি আফ্রিকায় এক ধরনের উপজাতি বন্দীদের কোতল করার আগে তাঁদের সামনে উদ্দাম নাচানাচি করে, তেমনই কিছু হবে হয়ত ব্যাপারটা। 

তখনই দরজার খটখট। বাবার গলায় "কী রে"!

বুঝলাম, বলির আগে পাঁঠার গর্দানের ফ্লেক্সিবিলিটি চেক করতে এসেছেন। 

দরজা খুলতেই হল। 

- এত রাত্রে তুমি? ঘুমোওনি বাবা?
- ঘুম আসছিল না। কাল নাকি তোর অঙ্ক পরীক্ষা?
- হ্যাঁ। 
- অঙ্ক। অঙ্কে তোর একটা ন্যাচুরাল ন্যাক আছে। সে'দিন স্কুলের মাঠে তুই অফ সাইডের ফিল্ড বাইসেক্ট করে যে'ভাবে কাটগুলো মারছিলিস, আমি নিশ্চিত। 
- ইয়ে, অঙ্কে আমার ন্যাক?
- স্পষ্ট। 
- গতবার ফেল করেছিলাম। বাইশ, একশোতে। 
- আমায় মার্কশিট দেখাস না। মার্কশিটের দৌড় আমার দেখা আছে। এই তোর দিদিকে দেখ, হিস্ট্রিতে ফার্স্টক্লাস। ইতিহাসে বস্তা বস্তা নম্বর পেয়েও ওর সোশ্যিও পলিটিকাল সেনসিটিভিটি কত কম! খবরের কাগজের পলিটিকাল খবর আর শেয়ার মার্কেটের হিসেবেকিতেব নিয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। কাজেই মার্কশিট দেখাসনি, বুঝলি? 
- বুঝলাম। 
- গুড। 
- না, আসলে গতবার রেজাল্ট বেরোনোর পর...। 
- আমি তোকে বকেছিলাম? বেশ করেছিলাম। ও'টা আমার প্রডাক্ট স্পেসিফিকেশনকে অনার করে। 
- প্রডাক্ট?
- প্রডাক্ট, যার নাম ফাদার। পিতা। বাপ। আমার স্পেসিফিকেশনে পড়ছে যে সন্তান রেজাল্টে ধ্যাড়ালে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলতে হবে। ফের রেজাল্ট খারাপ করলে ফের চেল্লাবো। ওই যে। প্রোডাক্ট স্পেসিফিকেশন। 
- ওহ্‌, আচ্ছা।
- ইয়ে। একটা বিয়ন্ড স্পেসিফিকেশন কথা বলার ছিল। 
- হুঁ? ওহ। বলো। 
- ডু নট শীল্ড ইওরসেলফ বিহাইন্ড নাম্বার্স। স্কোরবোর্ড সিন্ড্রোম থেকে বেরোও। কন্সটেলেসন চিনতে শেখো। গোলাপ চাষ শেখো। আর ইম্পর্ট্যান্ট ট্রিভিয়াগুলো জিভের ডগায় রাখো। যেমন গীতবিতানের প্রথম গান কী? 
- আমি ঠিক শিওর না...। 
- শেম শেম। ট্রিগোনোমেট্রি তো টার্শিয়ারি নলেজ্‌ ভাই। প্রাইমারিতে তোমার জানা উচিত ছিল যে গীতবিতানের প্রথম গান হচ্ছে কান্না হাসির দোল দোলানো। 
- ওহ। 
- এ'বার শুয়ে পড়। 
- না মানে, আর কয়েকটা টেস্টপেপার...। 
- জাগতে ইচ্ছে হলে গীতবিতান লাও। লিভিং রুমের বইয়ের শোকেসের নিচের খোপে। নয়ত ঘুমোও। 
- আচ্ছা। 
- আর ইয়ে। মা'কে আবার নেকু সেজে বলতে যেও না যে আমি বলেছি যে পরীক্ষায় নম্বর ইম্পর্ট্যান্ট নয়। আর রেজাল্ট বেরোলে আবার চিৎকার চ্যাঁচামেচি করব, কেমন? নতুন স্ক্রিপ্ট রেডী রেখেছি। 
- ওহ। আচ্ছা। 
- গুডনাইট খোকা। 

Comments

de trop said…
As usual Marvellous....But are you really afraid of mathematics??? heh heh heh...Well anyone can connect to your post...at least i can!!
Tamasa said…
pita..putro...tai khub bishesh kichu bolar nei...kintu ami jetuku amar baba er kaach theke peyechi setuku theke bolte pari.....a strong mind n an unbreakable determination to see his child at the pennacle of success is that wat i got from my pa.......
Poorna Banerjee said…
ami na... amar babatake boro bhalo bashi... nishchupe sab shoye jaay amar nirjaton.
Anonymous said…
ghotonataki sotti na kalponic?
পুত্রকে পিতাহীন করে দিলেন? এ কেমন বিচার আপনার? খুব অন্যায়!

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু