Sunday, March 16, 2025

প্রমথনাথ ও পরশুরাম



পাপী মানুষ। ভালো যা কিছু তার কদর করতে শিখিনি। ভালোমানুষজন ভালো কিছুর খোঁজ দিলে সন্দেহ হয়। দরদী মানুষ আলো জ্বেলে দিলে আঁতকে উঠে চোখে জলপটি দিয়ে আরামদায়ক অন্ধকার তৈরি করে নেওয়ায় আমার জুড়ি নেই।

পরশুরাম গল্পসমগ্রের গোড়াতেই রয়েছে ভূমিকা। ওপরচালাকিতে অভ্যস্ত পাঠক আমি; অমুক লেখকের বই কিনে তমুক সম্পাদকের কচকচি কেন পড়বো? এই নিরেট গর্দভ-যুক্তির সামনে নুয়ে পড়ে সে ভূমিকা আমি এতদিন (এত বছর) এড়িয়ে এসেছি। সংগ্রহে থাকা বইটার ঝুরোঝুরো অবস্থা, অথচ শুরুর পাতাগুলো উল্টে দেখা হয়নি।

এই আজ টের পেলাম সে ভূমিকা লিখেছেন সুপারস্টার প্রমথনাথ। ভূমিকাটা প্রায় একটা বড়গল্পের সমান আর প্রমথনাথের সিগনেচার স্টাইলে অনন্য। পরশুরাম যে কী মাপের মানুষ ছিলেন, সে'টা অ্যাপ্রিশিয়েট করার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু "আরিব্বাসরেবাস" বলার ছেঁদো কাজটুকু করতেই পারি। "হাস্যরস" ফচকেমো নয়, ফাজলামো নয়, ফিচলেমো নয়; সাহিত্য। সুগভীর সাহিত্য। পরশুরামের মত কিছু মানুষ ছিলেন, তাই বাঙালির সমস্ত হাসি উৎকট খ্যাকখ্যাক স্তরে এসে শুকিয়ে যায়নি।

সলজ্জ নিবেদন



"আরে অকারণে আবার এইসব কেন"

"কী দরকার ছিলো বলো এত হ্যাঙ্গামা করার"

"সামান্য ডালভাতেই হয়ে যেতো তো। খামোখা এত ঝকমারি..."

"মিলেট বিরিয়ানি হয় জানিস? সে'টা এ'রকম আনহেলদি নয়"

"আনিয়েছ যখন দু'চামচ খেয়ে নেব না হয়। এমনিতে রুটি-তরকারি হলেও সোনামুখ করে খেয়ে নিতাম"

ফুলসুতলি


- ও পিসে। চলো, সবাই বাসে বসে পড়েছে যে। এখুনি রওনা না দিলে ফুলসুতলি ফলসের ওদিককার ফ্যান্টাস্টিক সানসেট মিস করে ফেলব যে।
- তোরা এগো। আমি এ'খানে আছি।
- যাচ্চলে। তা হয় নাকি। ওঠো এ'বার।
- হব না কেন? বুড়ো দামড়া মানুষ একজন বলছে যে সে যাব না। তা না হওয়ার কি আছে?
- এদ্দূর এসে তুমি ফুলসুতলির সানসেট দেখবে না? বাবা বলে সে'টা নাকি এথিরিয়াল।
- আমি ভোলা টী স্টলের বেঞ্চিতে শুয়ে ওই গাছের পাতার দুলুনি দেখব। ভোলা বাবাজি বলেছে সে আমায় অনবরত ডিম ভেজে দেবে। কফির ব্যবস্থা নেই তবে হাইক্লাস লিকার চায়ের সাপ্লাই দেবে। তোরা বিদেয় হলে বাঁচি।
- কোথায় ফুলসুতলি আর কোথায়..।
- ফুলসুতলি ভোরবেলা পৌঁছতে হয়। ও'খানে হুজুই নামের একটা অবস্কিওর নদী আছে। তার পাশে মাদুর পেতে বসে কলা-মাখনটোস্ট-ডিমসেদ্ধ খেতে হয়। ফুলসুতলির পিছন দিকে মাতালমাথা শালবনে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। বেলা বাড়লে ফুলসুতলিতে স্নান। দুপুরে চাট্টি ভাতেভাতের ব্যবস্থা করতে হবে। কাঠের আগুনের ওপর মাটির হাঁড়ি, চাল সেদ্ধ হতে হতে প্রায় বিকেল। সে সেদ্ধভাত খেয়ে ফুলসুতলির পাশ ঘেঁষা টিলা দিয়ে সাবধানে উঠে যেতে হবে। তারপর আসবে একটা ভ্যিউপয়েন্ট, যৌবনে এসে সে জায়গার নাম আমি দিয়ে গেছি। আলোগান পয়েন্ট। সূর্য ডুববে, অল্প শীত। শরীরে ক্লান্তি থাকবে না অথচ একটা মিষ্টি অবসন্ন ভাব।
- সর্বনাশ করছে মামা। ফুলসুতলি ফলসে আধঘণ্টা কাটিয়েই এগোতে হবে। রাত হওয়ার আগে হোটেল না ফিরলেই নয়। মেজকাকু আগে থেকে পকোড়া অর্ডার করে রেখেছে। জ্যেঠিমার হটওয়াটার ব্যাগে রিফিল দরকার। বুল্টিদি হোটেল লনে অন্তাক্ষরী খেলার ব্যবস্থা করে রেখেছে।
- চোখের সামনে থেকে দূর হয় যা ভটকাই।আমার ভোলার পবিত্র মন তোদের মত ধান্দাবাজ টুরিস্টদের পাল্লায় পড়ে যেন বিষিয়ে না যায়। যা যা! তোদের বাস বিদেয় না হওয়া পর্যন্ত আমি আমার ট্র্যাভেল এঞ্জয় করতে পারছি না।

আতর



- এই যে স্যার...নমস্কার! বিকেলবেলা বাসস্টপে খামোখা একা দাঁড়িয়ে না থেকে এই প্রডাক্টটা..।
- চাই না, চাই না। সরে যান।
- প্লীজ। কিউরিওসিটিকে অকালে অক্কা পেতে দেবেন না। চারপাশে কত কী চমৎকার ঘটছে অনবরত..।
- দেখে তো মন হচ্ছে টাইগার বাম বিক্রি করছেন। না কি বাতের তেল?
- খামোখা আন্দাজে ঢিল মারলেও ঠকতে হবে স্যার। বাস আসতে এখনও মিনিমাম পনেরো মিনিট..। সময়টার সদ্ব্যবহার করুন।
- বলুন। কোন চমৎকার জিনিস আপনি বেচছেন।
- আতর।
- আতর? নাহ্। আপনার ম্যাজিক ফেল পড়লো। আমার বেয়াল্লিশ হলো গতমাসে। আজকাল বোরোলিন আর সর্ষের তেলে ছাড়া কোনো গন্ধ এ পোড়া দেহে সয় না।
- আমার প্রডাক্ট কি অতই এলেবেলে স্যার? এ আতরে গন্ধ নেই।
- গন্ধহীন আতর? ইয়ার্কি পেয়েছেন?
- এ আতরে বন্ধুর গন্ধ আছে। আপনজনের সুবাস।
- কীসের গন্ধ? কার সুবাস?
- কবজিতে দু'ফোঁটা ফেলুন। দু'বার শ্বাস নিন। ব্যাস। দেখবেন একাকিত্ব ঘুচে যাচ্ছে।
- আপনার মধ্যে বেশ একটা চালিয়াত গোছের ইয়ে আছে কিন্তু। প্লীজ, নিন্দে ভাববেন না।
- কিছুমাত্র মনে করিনি। তা, নেবেন?
- বাস আসা না পর্যন্ত আপনি এমন ভাবে পাশে দাঁড়িয়ে ঘ্যানঘ্যান করবেন?
- আপনি ভাবছেন আমি প্রডাক্ট পুশ করছি। অথচ আমি দেবদূতের মত আপনার জীবন পাল্টে দিতে চেয়ে ঝুলোঝুলি করছি।
- জীবন না পাল্টে ছাড়বেন না?
- এক শিশি সতেরো টাকা। জোড়ায় তিরিশ।
- একটাই দিন।
- খুচরো ম্যানেজ করতে পারবেন? তিরিশই ভালো না? তা'ছাড়া আমায় রোজ পাচ্ছেন কই।
- দিন দু'টো। আর তারপর প্লীজ, আমায় আর ঘাটাবেন না।

***

- অ্যাই ব্যাটাচ্ছেল ফুলু!
- বা...বা...বাবা তুমি...।
- বাপের কণ্ঠস্বর চিনতে পারছিস না রে ইডিয়ট?
- আঁ...আঁ...।
- পেট কামড়াচ্ছে নাকি?
- আমি কি স্বপ্ন দেখছি বাবা?
- মোটেও না। রীতিমতো বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চিতে বসে একা ঢুলছিস, আর আমি এই তোর পাশে এসে বসলাম।
- এদ্দিন পর...না মানে...।
- ভূতই বটে। কিন্তু তাও তোর বাপ তো। ন্যাকামি করিস না। তাছাড়া কে চায় এমনভাবে দেখা দিতে। নেহাত তুই কাক্সক ছড়ালি গায়ে। বাধ্য হয়ে আসতে হলো।
- কাক্সকটা কী বাবা?
- ওহ। তুই তো জানিস না। ও জিনিস গায়ে ঢাললে আপন মানুষের আত্মারা আশেপাশে এসে বসে। কখনও স্বপ্ন দেয়। কখনও সোজাসুজি গল্প ফেঁদে বসে। নিধু আর ওর মত আরও অনেকে ঘোরাঘুরি করে আর মানুষের গায়ে ওই কাক্সক আতর ছড়িয়ে বেড়ায়। সে সুযোগে আমরা একটু নিজেদের মানুষগুলোর কাছে আসি কয়েক মিনিটের জন্য। মানুষ এত একা রে ফুলু। আমরা মাঝমধ্যে নেমে না এলে যে তোরা পাগল হয়ে যাবি।
- আচ্ছা, ওই যে আতরবেচনেওলা? তাঁর নাম নিধু? সেও ভূত?
- ও মা। না না।
- সে মানুষ?
- না রে ফুলু। নিধু মানুষ বা ভূত হতে যাবে কেন। সে হলো খুয়ত। খুয়তদের কাজ এসব জিনিস আড়ালে আবডালে মানুষের গায়ে ছড়ানো। কিন্তু নিধু রাস্কে্লের আজকাল ব্যবসায় মতি হয়েছে। রেলস্টেশন বাসস্ট্যান্ডে ঘুরে ঘুরে আজকাল সে আতর বিক্রি করে লোক ঠকাচ্ছে।
- খু...খুয়ত? সে'টা কী?
- উম। কী করে বোঝাই। খুয়তরা ভূতেদের রোবট ধরে নে।
- মাথা ঘুরছে বাবা।
- চোখ ছলছল করছে কেন?
- বড্ড একা বাবা। এই যে তুমি এলে, এই যে আজেবাজে প্রশ্ন করে তোমায় বিরক্ত করতে পারছি...। আচ্ছা বাবা, তুমি কেমন আছ?
- তুই আচমকা হেসে উঠলি। তাই দিব্যি আছি।
- কতক্ষণ আছো?
- যতক্ষণ তুই বাসস্ট্যান্ডে , ততক্ষণ।
- তা'হল আজ দুটো বাস ছেড়েই দিই। কী বলো।
- দ্যাখ ফুলু, বিকেলের কী জেল্লা।
- এক্কেরে বিউটিফুল। তাই না বাবা?

ল অফ সন্ধে


ল অফ সন্ধে।
যে কোনো শহর, তার যে কোনো প্রান্তে,
সন্ধে মানেই তাতে বাড়িফেরার গন্ধ মিশে থাকবে।
ট্রেনেবাসে বাদুড়ঝোলা মানুষ,
অফিসটাইমের পথেঘাটে জেরবার মানুষ;
কে কোথায় নিজের বাড়ি ফেলে রেখে এসেছে তার ঠিকঠিকানা নেই, তাদের সহায়সম্বল বলতে শুধুই একটা কেজো বাসা। তবে তাতে বাড়ি ফেরার গন্ধ উবে যায় না। ছোটবেলার পাড়ার অলিগলি, ইয়ারবন্ধুদের গল্পগুজব, মাঠের ঘাসের ওপর পাতা হাওয়াই চটি, চৌবাচ্চার পাশের পিছল মেঝেতে হাত-পা ধোয়া; এরকম আরও কয়েকশো টুকরোর জিগস পাজল অফিস সন্ধের প্ল্যানচেটে ফেরত আসে।
ভূত সত্যি নয় বলে যেমন মিথ্যে হয়ে যায় না, রোজ সে ছোটবেলার বাড়ির ছবি মনের মধ্যে ভেসে না উঠলেও বাড়িফেরার গন্ধটুকু তো মিথ্যে নয়। প্রত্যেক সন্ধেবেলা সে গন্ধের ভূত আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করে। ভিড়ে, হুল্লোড়ে পাশে থাকে। সে গন্ধই ক্রমশ ছাপোষা মানুষকে তার শ্রেষ্ঠ রণহুংকার চিনিয়ে দেয়; "একদিন ঠিক বাড়ি ফিরব"।

ইলিশিস্ট


ইলিশের দাম অত্যন্ত চড়া। কাজেই চোয়াল শক্ত করে, নাছোড়বান্দা আশায় বুক বেঁধে ও জিনিস কিনতে হয়। মাছ বিক্রেতার সঙ্গে সুগভীর বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করতে পারলে ইলিশে ইনভেস্ট করার সাহসটা একটু বেড়ে যায় বইকি। বিশেষত এই নভেম্বর মাসে ভালো ইলিশ জোটানো চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু সমস্ত কিছু খাপেখাপ পড়লে এ অমৃত অতুলনীয়।

গতকাল আন্ধেরির মাছদাদার দেওয়া আশ্বাসে ভর করে আনা ইলিশটা সাধুভাষায় বললে "জাস্ট মারাত্মক"। বারচারেক রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়ার বদলে এমন হাইকোয়ালিটি ইলিশ একবার এনে তিনবেলা খাওয়া ঢের বেশি ভালো; বলাই বাহুল্য যে এ থিওরি একান্তই ব্যক্তিগত।

কালোজিরে কাঁচালঙ্কার বেগুন দেওয়া ইলিশের ঝোল, ও জিনিস দিয়ে আমি রোজকার চেয়ে অন্তত আড়াইগুণ বেশি ভাত খাই। আর সে ঝোলের পাশাপাশি আমার ডাল-ভাজা-তরকারি কিস্যু রোচে না। তবে ইলিশ দিয়ে এক থালা ভাত সাপটে খাওয়ার পর একটা মিঠেপান জমে ভালো। ঈশ্বরের আশীর্বাদ মনের মত একটা পানদাদাও জুটিয়ে নিয়েছি যিনি গুলকন্দ দেওয়ায় বাড়াবাড়ি করেন না এবং অন্যান্য মশলাও চমৎকার ভাবে ব্যবহার করেন। মাসে এক-দুবার শৌখিন পান খাওয়া, তাতে কোনোরকম কম্প্রোমাইজ বরদাস্ত করা যায় না; বিশেষত যদি সে মিঠেপান পোস্ট-ইলিশ আমেজ শান দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়।

বিজ্ঞাপন



আমার একটা ব্লগ আছে। ফেসবুক পেজ, ট্যুইটার হ্যান্ডেল সে'গুলোও ব্লগই বটে। তবে আমার ওই মান্ধাতা আমলের একটা ওয়েবলগ আছে, ব্লগারে।

আমার ধারণা ব্লগার গোটা পৃথিবীতে এখন জনা সতেরো মানুষ ব্যবহার করে, আমি তার মধ্যে একজন। দিন যায়, হপ্তা যায়, মাস যায়; ব্লগারে ফিচার বা টেমপ্লেট কিছু যোগ হয় না। সে এক অপরূপ ২০১১ মার্কা দুনিয়ায় সে প্ল্যাটফর্ম পড়ে আছে। ব্লগারের অ্যাপ (অন্তত অ্যান্ড্রয়েডে) ব্যবহারযোগ্য নয়। মাঝেমধ্যেই পোস্টের লিঙ্ক খুলতে চায় না। আমার ভারি দুশ্চিন্তা হয় গুগল একদিন এই ব্লগার ব্যাপারটা তুলে দেবে। কে জানে, হয়তো গুগলের দাদা-দিদিরা নেহাৎ ভুলে মেরে দিয়েছে যে ব্লগার বলে একটা ব্যাপার তাদের গোডাউনে পড়ে আছে। যে'দিন পুরনো আসবাবপত্রের ঝুল ঝাড়া শুরু করবে সে'দিন হঠাৎ ব্লগার ব্যাপারটা তাদের নজরে পড়বে আর পত্রপাঠ এ জিনিসটাকে তারা বিদায় দেবে।

যা হোক। আমার ব্লগের গুণগতমান কহতব্য কিনা সে'টা বড় কথা নয়। এই আমি যে এত বছর পরেও ব্লগারকে ছাড়িনি, সে জন্যই গুগলের উচিৎ আমায় গুগল-পে তে আড়াই টাকা ক্যাশব্যাক দিয়ে সেলুট জানানো।
ব্লগের ইউআরএল www.bongpen.net
নোটঃ এ'ট হাহুতাশ ( তিন প্যারা) + বিজ্ঞাপন (এক লাইন)