Skip to main content

সৈনিক আর হারমোনিকা


- বিল্টুবাবু!
- কে?
- ভয় পেয়েছ?
- তুমি কে?
- আমি? আমি সৈনিক।
- তুমি আমার শোওয়ার ঘরে এলে কী করে? তুমি কি ভূত?
- ঠিক ধরেছ। আমি ভূত। মৃত সৈনিকের ভূত।
- তুমি আমার ঘরে কেন এসেছ? আমি চিৎকার করলেই মা ছুটে আসবে কিন্তু।  তারপর তোমার যে কী দুরবস্থা হবে...।
- তুমি চিৎকার কেন করবে বিল্টুবাবু? তুমি কি ভয় পেয়েছ?
- ক্লাস ফোর পর্যন্ত খুব ভয় পেতাম, জানো। গতকাল ক্লাস ফাইভে যেই উঠেছি, অমনি ভয়টয় গেছে কমে।
- তাই? কী রকম ব্যাপারটা?
- ক্লাস ফোরে পড়ার সময়ও ধুন্ধুমার যুদ্ধ চলছিল তো। রোজ রাত্রে পাড়া অন্ধকার।  চুপটি করে বসে থাকা, এই বুঝি বোমা পড়ল। হারুদাদাদের কী হয়েছিল জানো তো?
- কী হয়েছিল?
- শত্রুদের একটা বোমা, পড়বি তো পড় এক্কেবারে হারুদাদাদের বাড়ি ছাদে। হারুদাদা, হারুদাদার মা, বাবা, হারুদাদার গরু লালি, আর আরও অনেকে; ছাই হয়ে গেছিল।
- ওহ হো।
- গোটা ক্লাস ফোর তো আমায় স্কুলেই যেতে হয়নি। যুদ্ধের জন্য।
- ওহ।


- জল...। একটু জল।
- চোপ্।
- আররে, মরেই তো যাচ্ছি। একটু জল দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে হে ক্যাপ্টেন?
- চারটে বুলেট খরচ করতে হয়েছে তোমার ওপর, তারপরেও এতক্ষণ তড়পে চলবে ভাবিনি।
- এই এক ঢোক জলের দাম পাঁচ নম্বর বুলেটের চেয়ে অনেক কম ক্যাপ্টেন।
- শত্রুকে জল দেব?
- পরাজিত শত্রু। মরতে বসেছে। জল দিলে বেঁচে উঠব না। দাও না ভাই ক্যাপ্টেন, এক ঢোক জল। তোমার পিঠের জলের বোতলটা দেখে থেকে কেমন মনটা আনচান করছে। তোমায় আশীর্বাদ করে যাব। বয়সে তুমি আমার চেয়ে বোধ হয় ছোট।
- এই নাও, জল। আর শোন, আমায় খবরদার ভাই বলে ডাকবে না। তোমার আশীর্বাদের মাথায় আমি লাথি মারি। এই নাও জল, হাঁ করো দেখি।
- আহ্, বাঁচালে ক্যাপ্টেন। মড়ার মুখে জল দেওয়া বড় পুণ্যির কাজ গো।
- আশা করি তোমায় বাঁচাইনি,  কিছুক্ষণের মধ্যেই ভবলীলা সাঙ্গ হবে। আর আমার পুণ্যির লোভও নেই। যুদ্ধটা জিতলেই যথেষ্ট।
- আমাদের প্রতিরোধ তো...। শেষের দিকেই..।
- হ্যাঁ, আর দিন দুয়েক। তারপর তোমাদের রাজধানী আমাদের দখলে।

- আচ্ছা বিল্টুবাবু, যুদ্ধ খুব খারাপ, তাই না?
- আমার বাবা যুদ্ধে গেছে, যুদ্ধ খারাপ কেন হবে? যুদ্ধ খারাপ হলে কি বাবা যুদ্ধে যেত?
- তাও বটে। তা যুদ্ধ তো শেষ। তোমার বাবা...।
- বাবা ফিরছে তো। সৈন্যদলের সঙ্গে। কুচকাওয়াজ করতে করতে। বিজয় নিশান উড়িয়ে। আর কয়েক দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে...।
- ওহ্, আচ্ছা।
- আমিও বাবার মত একদিন যুদ্ধে যাব। পরনে ইউনিফর্ম, হাতে বন্দুক। বাবার মত ফিরব কুচকাওয়াজ করতে করতে।
- তুমি বেশ সাহসী ছেলে তো বিল্টুবাবু।
- ক্লাস ফোরে আমি খুব ভীতু ছিলাম। এখন বেশ সাহস হয়ে গেছে। কিন্তু সৈনিক, তুমি এখনও বললে না কেন এসেছ! তুমি আমার বাবাকে চিনতে?
- চিনতাম বৈকি। আমাদের কত গল্প আড্ডা হয়েছিল। তোমার বাবা বেশ বীর যোদ্ধা। আর বড় ভালো মানুষ।
- তুমি জানো আমার বাবা খুব ভালো হারমোনিকা বাজাতে পারে?

- ক্যাপ্টেন!
- কই মাছের জান তোমার মাইরি। এখনও বেঁচে আছ। আর জল চাইলে পাবে না, এ'টুকু বলে দিলাম।
- তোমার পকেটে... তোমার পকেটে..।
- এ'টা? হারমোনিকা!
- শোনাবে? একটু? শোনাবে?
- নাহ্, পাঁচ নম্বর বুলেট তোমার মাথায় না গুঁজে দেওয়া পর্যন্ত তুমি বোধ হয় এমনি ভাবেই ঘ্যানঘ্যান করে যাবে।
- সমস্ত কেমন কালচে নীল হয়ে আসছে ক্যাপ্টেন।
- ওহ্, তার মানে আর দেরী নেই।
- জানো ক্যাপ্টেন, রিলোড করতে সামান্য তিন সেকেন্ড দেরী করে ফেলেছিলাম...নয়তো...।
- নয়তো তোমার বদলে এ'খানে আমার লাশ পড়ে থাকত।  জানি। স্কার্মিশে এমনটাই হয়। দু'তিন সেকেন্ডের দেরীতে হিসেব এ'দিক ও'দিক।
- আচ্ছা, ক্যাপ্টেন...। দোষ কার? তোমার দেশের? না আমার দেশের?
- দেশের আবার দোষ কী? নেতাদের ইচ্ছেয় যুদ্ধ। আমরা সৈনিক, হুকুম তামিল করব। ব্যাস।
- কালচে নীল ক্যাপ্টেন। কানে ঝুনঝুনি বাজছে। আমার খোকার রিনরিনে হাসি...।
- বয়স কত তোমার খোকার?
- বারো। ওর গালে টিপলে এখনও হাসির মধুর ঝরে ক্যাপ্টেন। খোকাও হারমোনিকা বাজায়।
- বটে?
- মন কেমনের বাঁশি গো ক্যাপ্টেন। আমার আর শোনা হল না।
- সরি।
- আরে ধুস। তুমি আমায় না মারলে..আমিই তোমায়...। হুকুম। তামিল। জানোই তো। তোমার বাড়িতে..।
- প্রায় ওই বয়সেরই আমার ছেলে। নাম বিল্টু।
- আমার ছেলের নাম ইবু। হারমোনিকা অন্ত প্রাণ,বাজাবে একটু? হারমোনিকা? ক্যাপ্টেন? ইবুর কথা বড় মনে পড়ছে। চারদিকে কালচে নীল...সমস্ত আলো নিভে যাচ্ছে।

- বিল্টুবাবু, তোমার বাবা অপূর্ব সুরে হারমোনিকা বাজায়। সে সুর শুনলে মনে হয় পাহাড় গলে পড়ছে। মনে হয় শিউলি টুপটাপ ঝরে পড়ছে ঘাসের নরমে। তোমার বাবার হারমোনিকায় মায়া আছে বিল্টুবাবু।
- তুমি বড় ভালোমানুষ সৈনিক। তুমি বাবার দলে ছিলে?
- আমি এখন তোমার বাবার দলে।
- তোমার নাম কি?
- ইবুর বাবা।
- ওহ।
- বিল্টুবাবু। আমি কেন এসেছি জানো?
- কেন?
- আমায় ক্ষমা করবে বিল্টুবাবু?
- মানে?
- আমায় হারমোনিকা শোনাতে গিয়ে...তোমার বাবা...।
- আমার বাবার কী হয়েছে সৈনিক?
- আমি খুব গোঁ ধরেছিলাম, আমায় একটু হারমোনিকা শোনানোর জন্য। আহা, কী অপূর্ব সুর তোমার বাবার হারমোনিকায়। কিন্তু হারমোনিকার শব্দে শত্রুপক্ষ তোমার বাবার পোজিশন জেনে যায় আর...।
- সৈনিক।
- সরি বিল্টুবাবু। আমায় ক্ষমা করবে?
- ক্লাস ফোরে থাকলে করতাম না। কিন্তু আমি এখন ক্লাস ফাইভ।
- কাঁদছ বিল্টুবাবু?
- ইবু কোন ক্লাসে পড়ে?
- ক্লাস ফাইভ। সেও হারমোনিকা বাজায় বেশ।
- তুমি ইবুর সঙ্গে দেখা করতে যাওনি?
- ইবুর কাছে ক্ষমা চাওয়ার নেই। কিছু ফেরত দেওয়ার নেই। বিল্টুবাবু, তোমার যদি কোনওদিন ইবুর সঙ্গে দেখা হয়, ওকে বলবে যে ওর বাবা মারা যাওয়ার আগের মুহূর্তে হারমোনিকা শুনতে শুনতে শুধু ইবুর কথা ভেবেছে?
- খুব কষ্ট হচ্ছে সৈনিক।
- তুমি না ক্লাস ফাইভে পড়ো?
- তবুও। বাবা। বাবার হারমোনিকা।
- সে'টাই তোমায় ফেরত দেওয়ার ছিল।

পরের দিন খুব ভোরের দিকে খবরটা পেয়ে মা এসে জড়িয়ে ধরেছিলেন বিল্টুকে। বিল্টুর বালিশের তলায় রাখা হারমোনিকায় তখনও বাবার গায়ের সুবাস।

Comments

একদিন আসবে যেদিন ইবুর আর বিল্টুর বাবাদের যুদ্ধে যেতে হবে না।

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু