Saturday, April 11, 2015

উল্লাস

হুইস্কির গেলাসে প্রথম চুমুকটা তাগড়াই হওয়া উচিৎ; অন্তত  অনিকেতের পলিসি সেটাই। গলার টাইটা আলগা করে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছিল সে। গুমগুম করে গান বাজছে। বিশাল ঘরটা জুড়ে হইহই। ইয়ার্লি টার্গেট পকেটে। অফিসের সবাই হুল্লোড়ে মাতোয়ারা। আর অনিকেত এসব অফিস পার্টির প্রাণপাখি। উল্লাস ব্যাপারটা তার সহজাত। রিয়ার মাথা অনিকেতের কাঁধে এলিয়ে পড়েছিল। গর্জাস মেয়ে। প্রথম পেগের শেষেই অনিকেতের মাথায় একটা ভালো লাগা ঝিমঝিম। রিয়ার কানের লতিটা নিয়ে খেলতে বেশ লাগছিল ওর। আর একটা পেগ। আরও একটা পেগ পেটে না পড়লে মিউজিকের ঝিকমিকটা মনে ছড়াবে না, পায়ে দুলকি আসবে না। কলিগরা ইতিমধ্যেই অনিকেতের হাত ধরে টানাটানি শুরু করেছে; সে ডান্স ফ্লোরে না এলে ডান্স ফ্লোরের ল্যাদ কাটবে না। “কাম অন অনি, হিট দ্য ফ্লোর”, বসও ডেকে গেছে বার কয়েক। 
অনিকেত এক চুমুকে শেষ করলো দ্বিতীয় পেগটা। “লেট্‌স গো রি”। রিয়ার কড়ে আঙুল ধরে টান দিল সে।

**
বাড়ির বারান্দায় একটা মোড়ার ওপর বিনু বসে। হলুদ রঙের একটা গেঞ্জি। ছ’মাস আগে তার নয় বছরের জন্মদিনে মা কিনে দিয়েছিল গেঞ্জিটা। একটা টিয়া পাখি রঙের হাফ প্যান্ট। বিনুর হাতে একটা আপেল। কামড়াতে মন চাইছিল না। 
বিনুর থেকে চার হাত দূরে বাবা বারান্দাতেই আসন পেতে বসে। বাবার সামনে থালা জুড়ে ভাত। এক বাটি ডাল। লম্বা করে কাটা বেগুন ভাজা দুই পিস। বাঁধাকপির তরকারী। বাবা মনে দিয়ে খেয়ে চলেছেন। 
বিনু শত চেষ্টাতেও আপেলে কামড় দিতে পারছিল না, ঘণ্টা-খানেক আগেই মাকে পুড়িয়ে শ্মশান থেকে ফিরেছে কি না। পারছিল না বিনু। বিনুর কষ্ট হচ্ছিল। 

**
শ্যাম্পেনের বোতলটা খোলার দায়িত্ব অনিকেতের ঘাড়েই পড়লো। অফ কোর্স। আফটার অল; পারফর্মেন্সে সক্কলকে টেক্কা দিয়েছে সে। অনিকেতের মনে হচ্ছিল যে আনন্দে ভেসে যাবে সে। 

**
মারা যাওয়ার ছ’মাস আগে মা একদিন বিনুকে বুকে জড়িয়ে বলেছিল “হ্যাঁ রে বিনু, আমি বোধ হয় বেশী দিন বাঁচবো না রে।আমি মরে গেলে কিন্তু তোকে নীলা মাসীকে মা বলতে হবে। পারবি তো বলতে?”
“ধ্যাত”, বিনু বলেছিল, “নীলা মাসি তো বাড়িওলা দাদুর মেয়ে। ও আমার মা হতে যাবে কেন? মা তো তুমি”। মা কথাটা শুনে হেসেছিল, অথচ মায়ের চোখে জলও ছিল।
সেই নীলা মাসীই বাবার আর বিনুর ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছিলেন। বাবা আর বিনু গ্রামের বাড়িতে যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল, মায়ের শ্রাদ্ধ সেখানেই হবে। নীলা মাসীও যাবে তাদের সঙ্গে। 
বিনু চুপ করে ঘরের এক কোণে বসেছিল। নীলা মাসী ব্যাগ গুছচ্ছিলেন। বাবা নীলা মাসীকে মাঝে মাঝে টেনে ধরছিল। হঠাৎ বাবা নীলা মাসীকে জিজ্ঞেস করেছিল “তোমার সব জিনিষপত্র নিয়েছ তো? ব্লাউজ-ব্রা সমস্ত কিছু?”। বলে বাবা সম্ভবত ফিচফিচ করে একটু হেসেছিল। নীলা মাসী কেন জানি বাবাকে হালকা একটা চিমটি কেটেছিল। 
বিনু কিছুই ঠাহর করতে পারেনি। কিন্তু বাবার কথাটা যে কেন তাকে ছুরির মত বিঁধেছিল তা সে নিজেই বুঝতে করতে পারেনি। বিনুর ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। ভীষণ। ভীষণ। বিনু সেই বয়েস থেকেই সবার সামনে কাঁদতে পারতো না। কিছুতেই না। কষ্ট সহ্য করতে পারতো শুধু। 

** 
আধো অন্ধকার...ঝমঝমে দুলকি গানের ঝড়। অবলীলায় রিয়ার কোমর জড়িয়ে নেচে যাচ্ছিল অনিকেত। পার্টি জমাট বাঁধছিল, আধো অন্ধকার জমাট বাঁধছিল। সেখান থেকে সমস্ত কিছুই অন দ্য রক্‌স। এ পাশ ও পাশ থেকে ভেসে আসছিল “থ্রি চিয়ার্স ফর অনি”। ভালো লাগার চেয়ে বড় নেশা কিছুই হয় না। অনিকেত জানতো। 

**
বিনুর দশ বছরের জন্মদিনের ঠিক দশ দিন আগে বাবা বলেছিল “কাল থেকে নীলা মাসীকে মা বলে ডাকবি বিনু। ঠিক আছে?”। 
বিনু সেদিনও বাবার সামনে কাঁদতে পারেনি। বাথরুমে ঢুকে হাউ হাউ করে কেঁদেছিল। অনেকক্ষণ। “মা মা মাগো” বলে কেঁদেছিল বিনু। সেদিন থেকে বাথরুমকে কান্নার অভয়ারণ্য বলে চিনেছিল বিনু। বাবা আর নীলা-মা যখন বাইরে ঘুরতে যেত, বিনু বাড়িতে বসে রান্না করতো। এগারো বছর বয়স থেকে বিনু ডাল, মাছের ঝোল রাঁধতে পারতো, ভাতের ফ্যান গালতে পারতো। বাসন ধোয়া, ঘর ঝাড় দেওয়া; কত কিছু পারতো বিনু।  শুধু না বলতে পারতো না। বিনু না বললে শুনবে কে? শোনার কেউ ছিল না। 
বিকেল বেলা খেলে ফিরতে দেরী  হলে নীলা-মার হাতে বেধড়ক মার খেত বিনু। পড়তে বসতে দেরী হচ্ছে বলে নয়। মুদীর দোকানে যেতে দেরী হচ্ছে বলে। সকালের বাজারে আনা আলুর ওজন নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় নীলা-মা হাতপাখার ডাঁট দিয়ে মেরে বিনুর ডান পা কেটে দিয়েছিল, গলগল করে সে কী রক্ত। বিনু ককিয়ে ওঠায় বাবা এসে জিজ্ঞেস করেছিল “এত হল্লা কিসের”। সমস্ত জানতে পেরে সেই হাতপাখা দিয়েই বিনুর অন্য পায়ে সপাটে এক ঘা দিয়েছিল বাবা। সেখানেও কেটে গিয়েছিল। 
ভাগ্যিস বিনুর বাথরুম ছিল। 
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনরকমে বাথরুমে ঢুকে হাপুস নয়নে কেঁদেছিল এগারো বছরের বিনু। “মা মা গো তুমি কোথায় মা। মা দেখ না আমার কী কষ্ট হচ্ছে। মা গো। আমার সবাই খুব কষ্ট দেয় মা। তুমি কেন চলে গেলে মা। আমার কষ্ট হচ্ছে মা। এত কষ্ট হচ্ছে যে বুকে ব্যথা করছে। তুমি বুঝতে পারছ না মা? খুব কষ্ট মা। তোমার বিনুর খুব কষ্ট। মা মা গো”। দুদ্দাড় করে কেঁদে চলে বিলু। কষ্ট খানিক পরে লাঘব হয়ে আসে। আরও খানিকক্ষণ যন্ত্রণা সহ্য করার দম ফেরত পায় বিনু। এভাবেই খানিক কান্নার পর সমস্ত ঠিক আছে ভাব নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতো  বিনু। এমন ভাবেই বাথরুমে কান্না ফেলে আসতো বিনু। 

**
ডান্স ফ্লোরের মায়াবী অন্ধকারে রিয়াকে জাপটে ধরে ভেসে যাচ্ছিল অনিকেত। নিজের হাতের ওপর কোন লাগাম থাকছিল না ওর, রিয়াও মাইন্ড করে না। হুইস্কির চার পেগে উজাড় হয়ে যাচ্ছিল অনিকেত। এমন সুতীব্র ভালো লাগা সেটা। 
-“ওপরে একটা রুম খালি আছে। চাবি আছে আমার কাছে। লেট্‌স গো দেয়ার অনি”, অনিকেতের কানে ফিসফিস করে বললে রিয়া।
-“ইউ আরে ইনক্রেডিব্‌ল রি” রিয়ার কোমর খামচে জানান দিলে অনিকেত, “হ্যাড টু মাচ টু ড্রিঙ্ক। আমি লু থেকে আসছি পাঁচ মিনিটে। তুমি ওপরে অপেক্ষা কর আমার”। 

টলতে টলতে কোনরকমে বাথরুমে ঢুকে হাপুস নয়নে কেঁদে ফেললে তিরিশ বছরের অনিকেত। “মা মা গো তুমি কোথায় মা। মা দেখ না আমার কী কষ্ট হচ্ছে। মা গো। আমার সবাই খুব কষ্ট দেয় মা। তুমি কেন চলে গেলে মা। আমার কষ্ট হচ্ছে মা। এত কষ্ট হচ্ছে যে বুকে ব্যথা করছে। তুমি বুঝতে পারছ না মা? খুব কষ্ট মা। তোমার বিনুর খুব কষ্ট। মা মা গো”। দুদ্দাড় করে কেঁদে চলে অনিকেত। কষ্ট খানিক পরে লাঘব হয়ে আসে। আরও খানিকক্ষণ যন্ত্রণা সহ্য করার দম ফেরত পায় অনিকেত। ঠিক যেমন করে ছোটবেলায় দম ফেরত পেত।  সমস্ত ঠিক আছে ভাব নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসলো বিনু। এমন ভাবেই ছোটবেলা থেকে অনিকেতের বাথরুমে কান্না ফেলে আসা। 


7 comments:

kingkhan said...

Osadharon. Aapni thakchen dada.

সোমনাথ said...

চমৎকার। হাসি কান্নার মধ্যে বাথরুমের দরজার আড়াল। ভারি ভালো লাগল সকাল বেলা।

অরিজিত said...

খুব সুন্দর লাগলো। সেইসঙ্গে বুকের ভেতরটা মোচড়ও দিয়ে গেল।

chupkotha said...

pore monta bhari hoye gelo na dekha ekta chhoto bachha r jonya

malabika said...

সত্যিই, সব কান্নার, সব কষ্টের আশ্রয় একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ বাথরুমই বটে। তবে বছরশেষের আনন্দের মোড়কে কি এত কান্নাকেই লুকিয়ে রাখতে হয়?

aditi said...

bhishon shundor

burningbright said...

nice twist. kintu boddo shada-kalo characterization.

dukkhito, ami Bangla horof-e likhte pari na.