Sunday, April 27, 2014

সুলিয়ার প্রেম

১।

গোটা দুপুর নিজেকে ছাদের ঘরে আটকে রেখে কেঁদেছে সুলিয়া। খুব কেঁদেছে। বাবা, মায়ের হাজার ডাকেও সাড়া দেয়নি। খায়নি। খিদে নেই। বুকে ফেটে যাওয়া যন্ত্রণা। প্রেম ভাঙার দুঃখ যতটা, তার চেয়েও বেশি দুঃখ তার নিজের বাবা এমন কাজ করলো বলে। কী করে? ছিঃ। ছিঃ।

২।

-   তুমি কি ঠিক করলে এটা ? আমাদের ওইটুকু মেয়ে, না হয় প্রেমে পড়েছে। এ বয়েসে তো এমনটা হতেই পারে। তাই বলে এমনটা –

-   সুলিয়া আমারও মেয়ে। বাবা হিসেবে কী করে মেনে নেব যে আমার মেয়ে একটা ভিন-গ্রহের কোন অজ্ঞাতকুলশীল কারোর প্রেমে পড়বে ? মানছি ছেলেটাও আমাদেরই মত মানুষ। একই হাব-ভাব। ওদেরও ভাষা আছে। সভ্যতা আছে। কিন্তু তার বাইরেও অনেক কিছু আছে সুলিয়ার মা। এই প্রেমের কোনও ভবিষ্যৎ ছিল না।

-   ওকে একটু বুঝিয়ে তো বলা যেত, তার আগেই তুমি ছেলেটার প্রতি এমন...। 

-   সুলিয়া বুঝতে চাইছিল না যে। দেখ সুলিয়ার মা। ব্যাপারটা বেআইনি। আমরা ওই গ্রহের মানুষজনের থেকে অনেক উন্নত। তাই আমরা ওদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ভাবে অবগত অথচ আমাদের গ্রহ বা সভ্যতা সম্বন্ধে ওদের কোনও ধারণা নেই। কিন্তু ওরা আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে গেলেই মুশকিল। পৃথিবীর অধিবাসীরা ভারি সুবিধার লোক নয় গো। ওদের ওখানে এখনও যুদ্ধের মত প্রাগৈতিহাসিক ব্যাপার-স্যাপার রয়ে গিয়েছে। ভাবতে পারো ?

Monday, April 21, 2014

অমলেট ও মামলেট

-          বাবা, কবিতা আর পদ্য কি এক ?

-          বাবু, মামলেট আর অমলেট কি এক ?

-          এক নয় ?

-          ভাব...।

-          একই তো।

-          চোখ বোজ। প্রব্লেমটায় কনসেন্ট্রেট কর। এ'বার বল, মামলেটে আর অমলেটে কী ফারাক ?

-          তুমি বলো মামলেট। নিতাইমামা বলে অমলেট।

-          গুড। আর ?

-          নিতাইমামার ফ্ল্যাট বাড়িতে গেলেই আমায় অমলেট খাওয়ায়। চিনামাটির সাদা প্লেটে কী সুন্দর ভাবে সাজিয়ে দেওয়া। ওপরে গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়ানো। প্লেটের এক কোণে থাকে অল্প টমেটো সস্‌। আর থাকে কাঁটা চামচ।

Friday, April 18, 2014

কলকাতা বিরিয়ানি সিরিজ

( ছবিটি এখান থেকে নেওয়া - www.missionsharingknowledge.wordpress.com)

গল্প ১  

ঈশ্বর – ভক্ত। তোমার তপস্যায় আমি অতি খুশি। বর দিতে চাইছি।

ভক্ত  – থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।হে হে হে হে...

ঈশ্বর - হয় তুমি জীবনভর পাবে ফ্রি বিরিয়ানি। দৈনিক এক প্লেট; সিরাজের হেঁসেল থেকে। নয়তো রম্ভা ও উর্বশী তোমায় দিনে একটি করে চুমু খাবে। জীবনভর। বিরয়ানী না চুমু ? যে কোন একটি বেছে নিতে হবে তোমায় বাপু।

ভক্ত  - মাউথ-ফ্রেশনার আর লিপ্‌-বাম’য়ের পিছনে এক গাদা খরচ করবার কোনও মানেই হয় না স্যার।

Thursday, April 17, 2014

রামকুমার ও চিঠি

রামকুমার পরনের শার্টের বুক-পকেট হাতড়ে একটা কাগজের টুকরো পেলেন। এই হচ্ছে এক মুশকিল। বাসের কন্ডাক্টর ভাড়া চাইলে, কিন্তু তাঁর মানিব্যাগ রয়েছে প্যান্টের পকেটে - তিনি বুক পকেটে হাত দিলেন কেন ? কারণ তাঁর বুক পকেটে তো কিচ্ছুটি থাকার কথা নয়। এবার কথা হচ্ছে তাঁর বুক পকেটে যদি কিছু থাকার কথা নাই থাকে, তবে এই কাগজের টুকরোটি এলো কি করে ? দু ভাঁজ করে রাখা ডায়েরির ছেঁড়া পাতা। কাগজটা ভাজ খুলতেই দেখলেন সেটা একটা চিঠি। অস্বস্তিতে পড়লেন রামকুমার। চিঠিটা পড়বার আগে বাস ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। রাত সাড়ে নটা বেজে গেছে- বাস প্রায় ফাঁকা, পাশের সিটে কেউ নেই। কন্ডাক্টর চলে যেতেই চিঠিটা মেলে ধরলেন তিনি।

প্রিয় রামকুমার,
আমাদের জগতে আপনাকে স্বাগত জানাই। মৃত্যু’র জগত মৃত নয়; মন্দ তো নয়ই। বরং বেশ রিমঝিম পরিবেশ। আপনার সময় বেশ কেটে যাবে।

Tuesday, April 15, 2014

উমাপদ-আহার-সেন্টার ও স্টেটাস

দুর্গাপুরে যে পাড়ায় আমাদের বাড়ি, সে পাড়ার এক কোনে ছোট্ট বাজার। বাজারের কোনে ছোট্ট  ভাত-রুটির হোটেল। উমা-আহার-সেন্টার। মালিক উমাপদ সমাদ্দার। পিছনে রান্নাঘর। সামনের চত্বরে পাঁচটা পুরনো কাঠের টেবিল আর খান কুড়ি চেয়ার। দোকানের সামনে মেনু-বোর্ড টাঙানো। আর দেওয়ালে টাঙানো সেই মেনু-বোর্ড আর মা তাঁরা ফার্নিচারের ক্যালেন্ডারের নিচে ভাব-গম্ভীর মুখে বসে থাকেন উমাপদবাবু। তাঁর সামনের টেবিলে হিসেবের খাতা আর মৌরির বাটি। উমা-আহার-সেন্টারে সকালের জলখাবার পাওয়া যায়; লুচি-তরকারি বা কচুরি-ডাল। পাওয়া যায় দুপুরের ও রাতের ভাত-মাছ-ডিম বা মুর্গির মাংস (পাঁঠার ঝোল পাওয়া যায় শনিবার রাত্রি ও রবিবার দুপুরে)। এ ছাড়া রাত্তিরে পাওয়া যায় রুটি ও ডিম বা প্লেন তড়কা (ঝাল, কম ঝাল, নো-ঝাল; তিন রকমের তড়কা মশলা পাওয়া যায়)। ওমলেট-টমলেটও পাওয়া যায়। এ হোটেলের কচুরি, মাছের ডিমের বড়া, ডিমের ঝোল আর তড়কার বিশেষ সুখ্যাতি রয়েছে।  উমাপদবাবুর ছেলে মিন্টু বাপকে বহুদিন ধরে বলে চলেছে সন্ধেবেলা এগরোল-চাউমিনের ব্যবস্থা রাখতে; কিন্তু উমাপদ রাজি হচ্ছেন না নতুন ‘প্রোডাক্ট’ চালু করবার ঝুঁকি নিতে।

Sunday, April 13, 2014

ফাদার্‌স অ্যান্ড সান্‌স

- স্যার আসবো ?
- আসুন। 
- আজ্ঞে আমি সামন্ত। ভজহরি সামন্ত। ঢাকুরিয়া থেকে আসছি। ওই গতকাল কথা হয়েছিল। 
- ও, হ্যাভ আ সিট। 
- থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। ওই স্ক্র্যাপ’য়ের ব্যাপারে…
- জাস্ট গিভ মি আ মিনিট। একটা আর্জেন্ট মেইল সেন্ড করে নি।…………………………………………...হুম, এই বার বলুন। 
- আজ্ঞে আমি সামন্ত। ভজহরি…
- বললেন তো।কাজের কথায় আসুন। 
- আপনাদের লোহার স্ক্র্যাপ প্রচুর জেনারেট হয় শুনলাম। 
- লোহা নয়। সোনা। 
- আজ্ঞে ?
- ওয়েল, আই মিন আমাদের যে আয়রন ওয়েস্ট জেনারেট হয়, রোলিং মিল্‌সগুলোর কাছে সেগুলো সোনার সমান। 
- হে হে, বটেই তো স্যার। সান্যাল সাহেবও তাই কথাই বললে। 
- সান্যাল আপনাকে পাঠিয়েছে ?
- আজ্ঞে। উনি বুঝি আপনাকে বলেননি কিছু ? 
- বলছিল বটে কিছু একটা আমাদের সাঁতরাগাছির ফ্যাক্টরির ব্যাপারে। এনিওয়েজ বলুন আপনার এখানে আসার অবজেক্টিভ। সিগারেট চলে ?
- হে হে হে। সো কাইন্ড অফ ইউ। 
- আসুন। 
-  ওই সাঁতরাগাছির ফ্যাক্টরির স্ক্র্যাপের ব্যাপারে ইন্টারেস্ট নিয়ে এসেছিলাম। সান্যাল সাহেব বললেন যে আপনিই ডিসিশন-মেকার। 
- আদৌ নয়। আমি স্টোর আর পারচেজ সামলাই বটে, তবে আমারও ওপরওয়ালা রয়েছেন।

Thursday, April 3, 2014

মাছের বাজার


বাজারের মুখে এসে রিক্সা থামতে কালোকইবাবু আনন্দবাজারটা মুড়ে পাঞ্জাবির ঝোলা পকেটে গুঁজলেন। ছপাত শব্দে আনাজ বাজারের ঘোলা জল ঠেলে এগিয়ে গেলেন আমিষ বাজারের দিকে। শাক-পাতি পরে কিনলেও হবে, কিন্তু বেলা বেড়েছে কি টাটকা মানুষজন সব হাওয়া হয়ে যাবে। গিন্নী এদিকে আবার কচি মানুষের মাথা দিয়ে আজ ঘিলু-চচ্চড়ি রাঁধবেন, খোকা বড়-খাল থেকে ফিরছে আজ গরমের ছুটিতে।


হুড়মুড় করে এগিয়ে যাবেন এমন সময় ছলবাত শব্দে ধাক্কা বিধুকাতলা বাবুর সঙ্গে।
- সামলে কালোকইবাবু, সামলে। আমার এমন ধ্যাপস চেহারাটি চোখ এড়ায় কি করে মশায় ?”, এক গাল হেসে বললেন বিধুকাতলা।
-ইয়ে, মানে দেরি হয়ে গেল কিনা। বেলা বাড়লেই তো আবার সেই অন্ধ্র থেকে চালান আসা মরে সাদা হয়ে যাওয়া মানুষ কিনতে হবে। টেস্ট নেই, কেরোসিনের গন্ধ। দাম দু পয়সা বেশি দেব কিন্তু বাঙালি কচি খোকামানুষ ছাড়া রবিবারের পাতে পোষায় না”  
-তা যা বলেছেন। তবে মাগ্যির বাজারে, রোজ রোজ বাঙালি খেতে হলে যে ব্যাঙ্ক ব্যাল্যান্স লাটে উঠবে মশায়

মৃদুলবাবু এবং আলু-সেদ্ধ



মৃদুলবাবুর একটা জবরদস্ত চাকরি নেই; কাজ বলতে বড়বাজারের এক মাড়োয়ারি গদিতে খাতা সামলানো।
কিন্তু তাঁর রাতের খাবারের স্টিলের থালাটির কোনায় এক খাবলা চন্দ্রমুখী আলু-সেদ্ধ রয়েছে।

মৃদুলবাবুর আর সংসার করা হয়ে উঠলো না। বয়স প্রায় পঞ্চাশ, নতুন করে কিছু হবে- সে সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায়। বাপ-মা বহু আগেই গত হয়েছেন, সময়মত উঠে-পড়ে তাঁর বিয়ে দেওয়ার জন্যে তেমন কেউ ছিলেননা
তবে তাঁর পাতের কোণে রাখা আলু-সেদ্ধর ড্যালাখানা অতি মিহি ভাবে যত্নে চটকে মাখা।

পার্টির কাজ

-     “ পার্টির কাজ ? খুব পারবো বিনুদা। আমি খুব খাটবো, দেখো। কিন্তু চাকরিটা হবে তো ?”
-     “ ডিগ্রী দিয়ে তো কিস্যু করতে পারলি না, পার্টিকে ভরসা করে দেখ”
২।
-     “ জান লড়িয়ে দেব বিনুদা। দরকার হলে পাড়ায় প্রত্যেককে জনে জনে বোঝাব। আমাদের পলিসির কথা, আমাদের লক্ষ্যের কথা। কিন্তু ভোট এদিক ওদিক হতে দেব না। তুমি দেখো”
-     “ মুখের ভাষা সকলে বোঝেনা নীলয়। প্রয়োজনে…”
-     “ কিন্তু আইডোলজির কথা যদি…”
-     “ পেটের কথা ভাব। তোর মা’র ক্যানসারের কথা ভাব। আইডোলজিতে পেট ভরে না ক্যানসার সারে?”

বসন্ত উৎসব

-          আমাদের পাড়ায় একটা ফাংশন রেখেছি আগামী শনিবার। ওই আমাদের বেতলা ইয়ুথ ক্লাবের তরফ থেকেই অরগানাইজ করা আর কি। সবার ভারি ইচ্ছে যে এম-এল-এ কি দিয়ে উদ্বোধন করানোর। আপনার সঙ্গে আমার ইয়ে যে আছে সেটা সবাই জানে। তাই বললে আমি যেন আপনাকে অনুরোধ করি। না করবেন না স্যার, ছেলেরা আমার উপর ডিপেন্ড করে আছে। আপনার নামের  ওয়েলকাম ব্যানার পর্যন্ত
-          কালচারাল ইভেন্ট ?
-          এই পাড়ার ছেলে মেয়েরা মিলে। বসন্ত উৎসব।
-          বসন্ত উৎসব ?
-          ওই আর কি। পাড়ার ছেলে মেয়েরা মিলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। খান তিনেক রবীন্দ্রসঙ্গীত, দুটো নাচ। আবৃত্তি। ছেলেদের রিকুয়েস্টে একটা নাটকও…
-          ক্যালক্যাটায় বসন্ত কোথায় মশায় ?

Wednesday, April 2, 2014

অপুর সংসার

কদিন ধরে এ সময়ে মেঘ করে আসছে নিয়মিত। বৃষ্টি হচ্ছে না। আকাশ দানা দানা গুমোট জমা করে; তারপর নিজের মনেই অবহেলায় নষ্ট করে দেয় নিজের মেজাজ। দোতলার এই ঘুপচি ঘরের এই সামান্য ফোঁকর; জানালা না বলে বেয়াড়া সাইজের ঘুলঘুলি বললেই মানায় ভালো। সে জানালার চার খানি শিক ঘরখানার মধ্যে কয়েদখানার গন্ধ সঞ্চার করে। ওই শিক গুলো পেরিয়ে দৃষ্টি স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল বেয়ে নেমে যায় কলকাতায়, অথবা জলের পাইপ বেয়ে উঠে যায় আকাশে।

এই আধলা জানলাখানা এই ঘুপচি ঘরে ভারি মানানসই। এই ঘুপচি ঘরখানাও আবার এই হাড়গিলে-বুড়ো বাড়িতে মানায় ভালো। ঠিক যেমন ভাবে এই বুড়ো বাড়ির দেওয়াল দিব্যি দাঁড়িয়ে যায় এই ঘিঞ্জি কলাকাতাইয়া গলিটিতে।  ভাবনাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দেন অপূর্ব আর সিগারেটের ধোঁয়া মাখানো দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন জানালার ওপারে।

ঘুপচি ঘরে আধ ভাঙা জলচৌকি। একটা কুঁজো। অল্প বাসন। দুটো হাত পাখা যার একটা ভাঙা। একটা আশি পাওয়ারের বাল্ব। সতের বছরের পুরনো একটা টেবিল ফ্যান; যার খাজনার থেকে বাজনার পরিমাণ দৃষ্টিকটু ভাবে বেশি।

অপূর্ব জানালায় মন বসান। বিকেলের আকাশ-মেঘ ফাঁকির তাল করছে। অপূর্ব নিজের সত্তর বছরের গালের খসখসে চামড়ায় হাত বুলিয়ে নেন। হাসি আসে, সঙ্গে কাশি। ওষুধের কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। ওষুধের কথা মনে আসতেই কালচে দেওয়ালের কালচে ফ্রেমে বাঁধা লালচে ফটোয় চোখ চলে যায়। ঘরের আলো ঘোলাটে না তাঁর দৃষ্টি; স্থির বুঝতে পারেন না তিনি। না কি স্মৃতি টলমল করছে বলে এমন আবছায়া ?